কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব, অর্থনৈতিক বাস্তবতা গুরুত্ব দিতে হবে

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব, অর্থনৈতিক বাস্তবতা গুরুত্ব দিতে হবে

১৫ জানুয়ারি সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান পুনর্বহালের প্রস্তাবও করেছে। ১৬ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবের বিস্তারিত উঠে এসেছে। তা থেকে জানা যাচ্ছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু করার জন্যও সুপারিশ করেছে। এ দ্বিকক্ষে যাতে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরির জন্যও সুপারিশ করেছে।

 

 

কমিশন মনে করে, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করেছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সে কারণে যাতে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ ও নির্বাহী বিভাগের দুটি পদÑ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন চেক অ্যান্ড ব্যালান্স হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। সে কমিশনে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার যারা আসবেন বিরোধী দল থেকে এবং একজন থাকবেন যিনি অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবেন। কমিশন মনে করে এ প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে পারবে।

 

 

 

বর্তমানে দেশের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে নারীর জন্য ৫০টি সংরক্ষিতসহ মোট ৩৫০টি আসন রয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব যে আসতে যাচ্ছে তা একরকম অনুমান করা যাচ্ছিল। সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা বেড়ে ৪০০ হওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর সঙ্গে উচ্চকক্ষে আরও ১০৫টি আসন যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনের ১০০ নারী আসন। তবে কেবল দলের মনোনয়নে নয়, তাদেরও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। সংবিধান সংস্কারের জন্য এখন পর্যন্ত শুধু প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দরকার।

 

 

আবার কিছু কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য জনভোটে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। তবে এ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে নিম্নকক্ষে ৩০০ আসনের বিষয়টি ঠিক আছে। তার পরও মোটা দাগে কিছু বিষয়ে পর্যালোচনা না করলেই নয়। এ ৩০০ আসনে যেকোনো লিঙ্গের প্রার্থী দেশের নাগরিক হলেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। কিন্তু আমার আপত্তি মূলত নারীদের প্রতিযোগিতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার দিকগুলো নিয়ে। সচরাচর সবার জন্য উন্মুক্ত আসনে দেখা গেল দুটি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে।

 

 

কিন্তু যখন নারীরা প্রতিযোগিতা করছেন তখন দেখা গেল তারা ছয়টি উপজেলার অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দেশে নারী-পুরুষের শ্রমের স্বীকৃতি ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নারী প্রার্থীদের আদৌ নির্বাচনী প্রচারের সে সক্ষমতা রয়েছে কি না, বিষয়টি একটি বড় প্রশ্ন। নির্বাচনী প্রচারের জন্য নানা ধরনের ব্যয় রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারের সময় শুধু পোস্টারিং করলেই হয় না। তার প্রচারের জন্য যানবাহনের খরচ প্রয়োজন হয়, লোকবল নিয়োগের জন্য অর্থায়ন করতে হয়। আমাদের দেশের নারীরা আর্থিকভাবে কি এতটাই সক্ষম? সংরক্ষিত আসন হোক কিংবা ৩০০ আসনেই হোক, নারীদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে; যা একটি রূঢ় বাস্তবতা। তাহলে এ সমস্যা সমাধান করার উপায় কী? এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

 

মূলত পিপল রিপ্রেজেন্টেটিভ অর্ডার অনুযায়ী প্রতিটি রাজনৈতিক দলে যদি অন্তত ৩০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায় তাহলে প্রতিযোগিতার ভারসাম্যহীনতা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব। এমনটি হলে রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে নারীরাও অনুপ্রাণিত হবেন এবং তারা আরও সক্রিয়ভাবে মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে জনসংযোগ করতে পারবেন। এভাবে নারীর রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পথ সুগম করা সহজ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতান্ত্রিক কাঠামো অনুসারে নিজেদের রিস্ট্রাকচারিং করতে পারে তাহলে এতগুলো সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হয় না।

 

 

এ ক্ষেত্রে মনে হয় ৫০টির বেশি আসনের প্রয়োজন আমাদের নেই। এর মানে এই নয়, আমরা সংরক্ষিত আসন বাদ দেব। পটপরিবর্তনের পর আমরা বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখছি। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন তখনই হবে যখন দেশের সকল শ্রেণির এবং সকল পর্যায়ের মানুষকে এ সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। আমাদের দেশ ক্ষুদ্র হলেও এখানে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে।

 

 

এ বৈচিত্র্যের মধ্যে আমরা বাংলাদেশি পরিচয়ে আবদ্ধ। ফলে এ বাংলাদেশি পরিচয়ের মধ্যে যদি সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হয় তাহলে দেশের পিছিয়ে পড়া, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করা জরুরি। এ বিষয়টি নিয়ে ইতঃপূর্বে বহুবার আলোচনা হয়েছে কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার নানা স্থবিরতা এ সদিচ্ছার বাস্তবায়নে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে জিইয়ে ছিল।

 

 

তাই আমাদের নিম্নকক্ষে সংরক্ষিত আসনে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা, প্রতিবন্ধী, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সুবর্ণ সুযোগ মিলবে। যেহেতু এখনও সময় আছে তাই এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। হ্যাঁ, সংরক্ষিত আসনে নারীদের প্রাধান্য একেবারেই বাতিল করে দিতে হবে এমনটি বলতে হবে না। যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার কম মনে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য ২০-৩০টি আসন রেখে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার প্রতিনিধিদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংসদে ঠাঁই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

 

এবার আসা যাক উচ্চকক্ষের আলোচনায়। এ কক্ষে আনুপাতিক হারে ১০০ প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন এবং পাঁচজন নির্বাচিত হবেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক। এভাবে যদি জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ে তাহলে দেশের জনসংখ্যার নিরিখে জনপ্রতিনিধিত্বের সুষম বণ্টনের বিষয়টি নিশ্চিত করা সহজ হবে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান বিবেচনা করতে হবে। বিশেষত দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

 

 

সামাজিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এমন এক রূপ ধারণ করেছে যা পুরোপুরি অনুধাবন করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। এমন এক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে যখন অসংখ্য জটিলতা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থ উপদেষ্টা আন্তরিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোকে সবল করার কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতিও দেখা গেছে। এজন্য তাদের প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমছে এবং পটপরিবর্তনের পর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে পলাতক রয়েছেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উৎপাদনও অনেকাংশে মন্থর হয়ে রয়েছে।

 

 

দেশের এমন পরিস্থিতিতে আমরা এখনও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদ কাঠামোর জন্য প্রস্তুত নই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের এ প্রস্তাব থেকে একটি প্রশ্নই মনে আসে, আমরা কি সে ধরনের কাঠামোর দিকেই এগোচ্ছি? কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের জটিল নির্বাচনী প্রক্রিয়াও জনগণের ভোটের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আর নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমরা যদি জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বাড়াতে এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে নির্বাচন আয়োজনের খরচ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের রাষ্ট্রীয় ভাতা, সুযোগসুবিধা ইত্যাদিও সঙ্গতই বাড়বে।

 

 

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নির্বাচন আয়োজনে এত বিনিয়োগ করা কঠিন। তাই সংস্কার কমিশনের সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখার। কারণ, একটি কাঠামো বা প্রস্তাব দিলেই হয় না। তার বাস্তবায়নের জন্যও সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতার নিরিখে তাকে সংবেদনশীল করে তোলার জন্যই সংস্কার। এ কাজটি এ কমিশনকে করতে হবে। যখন এ সংস্কারগুলো সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী ও ফলোদ্দীপক হয়ে উঠবে তখন সংস্কারের সুফলভোগী হবে রাষ্ট্রের জনগণ।

 

  • স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়