কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সংস্কার কমিশনগুলোর অগ্রাধিকার

দিলীপ কুমার সরকার ।। প্রকাশ : যুগান্তর, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

সংস্কার কমিশনগুলোর অগ্রাধিকার

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, দেশ এখন সংস্কারের পথে যাত্রা শুরু করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, ড. আলী রিয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন, আবুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচারপতি আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন এবং সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে কমিশনগুলো কার্যক্রমও শুরু করেছে। এদিকে গত ১৭ অক্টোবর আরও ৪টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেগুলো হলো-জাতীয় অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খানকে প্রধান করে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, কামাল আহমেদকে প্রধান করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহাম্মদকে প্রধান করে শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তাদের সুপারিশমালায় যেন জনআকাঙ্ক্ষাগুলো গুরুত্ব পায়। গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর অগ্রাধিকারগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

 

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন প্রণয়ন; নিয়োগ আইনে অনুসন্ধান কমিটিতে সরকারি ও বিরোধীদলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ প্রদান; নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত সব জনবল নিয়োগের ক্ষমতা কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা; সংবিধান সংস্কার কমিটির কাছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করার আহ্বান জানানো; একই কমিটির কাছে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণসহ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তনের সুপারিশ করার আহ্বান জানানো, মনোনয়ন বাণিজ্য ও নির্বাচনে টাকার খেলার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদান; নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, অতীতের মতো যাতে কোনো জেন্ডার গ্যাপ না থাকে; আইন অনুসরণ করে যথাযথভাবে নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ; হলফনামার ছকে পরিবর্তন এনে তথ্যবিভ্রাট দূর করা; পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও কারসাজিমুক্ত করার লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ বিভিন্ন বিধিমালায় সংশোধনী আনা ইত্যাদি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ অবস্থায় প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ‘না’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন এবং নির্বাচনে ব্যয়-হ্রাসের লক্ষ্যে কমিশনের উদ্যোগে প্রতিটি আসনে প্রার্থী পরিচিতি সভা, হলফনামার তথ্য ভোটারদের মাঝে ছাপিয়ে বিতরণ, প্রতিটি আসনের জনবহুল স্থানগুলোয় প্রার্থীদের ছবি ও প্রতীকসংবলিত বিলবোর্ড স্থাপন ইত্যাদি বিষয় সুপারিশমালায় আনা।

সংবিধান সংস্কার কমিশন : সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন; এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণসহ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন; উচ্চকক্ষের জন্য নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা ও উচ্চকক্ষকে পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের রূপ দেওয়া; এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না এমন বাধ্যবাধকতা (টার্ম লিমিট) সৃষ্টি; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করা এবং সংবিধানকে প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের সংবিধানে পরিণত করা। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংশোধনের সুযোগ আছে কিনা, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। এ ক্ষমতা সরকারের না থাকলে সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এমনভাবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে হবে, যাতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং অন্যান্য দল তাতে সমর্থন দেবে-এমন অঙ্গীকার করবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, জনপ্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণমুক্ত করা ও রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ করা; পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে দলীয়করণমুক্ত করা এবং মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে সব ধরনের নিয়োগ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা; দক্ষতা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততাকে পদোন্নতির পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনায় নেওয়া; ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সরকারি কর্মসূচিতে পরিণত না করা এবং কোনো দলীয় কর্মসূচিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন : বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন; বিচারপতিদের নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়ন; আইনের ভিত্তিতে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের বিচারক হিসাবে নিয়োগ প্রদান; বিচার বিভাগের আওতায় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বলয় থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করা।

দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন : দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, দুর্নীতি দমনকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আওতায় আনা; আইনের ভিত্তিতে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দুর্নীতি দমন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ প্রদান; ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বলয় থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মুক্ত করা; দুর্নীতিবাজদের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্যোগ; বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ; আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুণ্ঠনকারীদের বিচারের আওতায় আনা এবং কমিশনের অনুসন্ধান ও গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্বারোপ করা।

পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন : পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, পুলিশ প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণমুক্ত করা; পুলিশ প্রশাসনকে কোনো দলের কাছে নয়, রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ করা; নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা; পুলিশ প্রশিক্ষণকে আরও উন্নত করা এবং মানবাধিকারের বিষয়টি সম্পর্কে প্রশিক্ষণে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা; নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিশ্রামের পর্যাপ্ত সময় প্রদানসহ অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে পুলিশ সদস্যদের মুক্ত করা; পুলিশ লাইন্সগুলোতে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত আবাসনব্যবস্থা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা; দক্ষতা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততাকে পদোন্নতির পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনায় নেওয়া; গোয়েন্দা সেলের সক্ষমতা বৃদ্ধি; গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ; কোনো দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা।

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন : স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হলেও একে মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা; জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলাসহ প্যাথলজিক্যাল ফেসিলিটিস বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা; ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক ডাক্তারের পদায়নসহ কর্মস্থলে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা; হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা; গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা; সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা এবং স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অবসান ঘটানো।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন : গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, গণমাধ্যম যাতে ভীতিমুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা; সাংবাদিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি কাঠোমো তৈরি করা; অপসাংবাদিকতা প্রতিরোধে ব্যবস্থা রাখা; একটি স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সত্যিকারের ‘ওয়াচ-ডগে’র ভূমিকা পালনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা; সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বিয়োজনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাপরিপন্থি সব নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা এবং গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তাসহ বেতন-ভাতাদির বিষয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত করা।

শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন : শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, শ্রমিকের সংজ্ঞায় কৃষি শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা; ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপন ও পুষ্টিচাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ; নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য দূর করা; স্বল্প আয়ে ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপনে সহায়তার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু; শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিয়ে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান; কারণে-অকারণে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা; শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও পেনশনসহ তাদের বিমা সুবিধার আওতায় আনা; কৃষিবিমা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ; প্রবাসে কর্মপরিসর বৃদ্ধি ও শ্রমবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে সরকার কর্তৃক যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ; প্রবাসী শ্রমিকদের বিমানবন্দরে ভিআইপি হিসাবে গণ্য করা এবং রেমিটেন্স প্রেরণকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা ব্যবস্থা করা।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন : নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষ্যমের অবসান ঘটানো; সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা; জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সম্পত্তিতে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা; জাতীয় সংসদসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ এবং ওই আসনগুলোয় সরাসরি নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ; ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং নারী নির্যাতন ও নিপীড়নে বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়া আরও দু-একটি বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ। কেননা আমাদের সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার আলোকে (১১, ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আইন প্রণয়নের প্রত্যাশা থাকলেও তা অদ্যাবধি হয়ে ওঠেনি, বাস্তবায়ন করা যায়নি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চেতনা। অথচ স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে সংসদ-সদস্যদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনগুলো নির্দলীয় ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতিতে আয়োজন, জেলা পরিষদ নির্বাচন মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে না করে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে আয়োজন, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং ক্ষমতা, দায়িত্ব ও সম্পদে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা ইত্যাদি এখন সময়ের দাবি। এসব দাবি পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা উচিত।

পরিশেষে, আমরা যত ধরনের সংস্কারের পথেই হাঁটি না কেন, যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন না আনতে পারি, তবে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। তাই, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী করতে হবে। নিবন্ধনের শর্ত হিসাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষ ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার পরিহার ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান ‘উইনার-টেকস-অল’ বা বিজয়ীদের সবকিছু করায়ত্ত করার ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। বিরোধীদের দমনপীড়নের সংস্কৃতির অবসান হওয়াও জরুরি। পাশাপাশি পারস্পরিক বিরোধিতার পরিবর্তে, পারস্পরিক সহযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে।

 

দিলীপ কুমার সরকার : কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)