শ্রমবাজার বলতে এখন শুধুই সৌদি আরব
শফিকুল ইসলাম [প্রকাশ: বণিকবার্তা, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫]

কর্মসংস্থানের উদ্দেশে চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ১০ লাখ ৭৬ হাজার বাংলাদেশী। যার প্রায় ৬৭ শতাংশ কর্মী ভিসায় গিয়েছেন সৌদি আরবে। এর বাইরে বাকি কর্মীদের অধিকাংশ গেছেন সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপসহ মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশে। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর বৈশ্বিক শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ, বন্ধ শ্রমবাজার চালু করা এবং নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় প্রত্যাশা। কিন্তু দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৌদি আরবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। বন্ধ অনেক শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়নি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন কূটনীতি কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং বন্ধ শ্রমবাজার চালুর ক্ষেত্রে বড় সফলতা পায়নি। যে কারণে নতুন শ্রমবাজার তৈরি হয়নি। তারা বলছেন, এ সীমাবদ্ধতার পেছনে মূলত কাজ করেছে শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি করতে না পারা। এছাড়া অবৈধভাবে বাংলাদেশীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ, ভুয়া কাগজ ব্যবহার, মানবেতর জীবনযাপনসহ নানা কারণে নেতিবাচক ভাবমূর্তি আগে থেকেই রয়েছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা সামনের দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
(বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক দশক আগেও বিদেশে বাংলাদেশীদের বড় শ্রমবাজার ছিল অন্তত ১২টি। এখন তা দুই-তিনটি দেশে নেমে এসেছে। বিশেষ করে সৌদি আরব ছাড়া আরো যে পাঁচ দেশ শীর্ষ শ্রমবাজারের তালিকায় আছে
তার মধ্যে বর্তমানে সিঙ্গাপুর, কুয়েত, কাতার ও মালদ্বীপের বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী অন্য কোনো দেশে যাচ্ছেন না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছর বিভিন্ন দেশে মোট কর্মী গেছেন ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৬ জন (এ হিসাব ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এর মধ্যে ৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৬ জন কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। এর বাইরে ১ লাখ ৪ হাজার ৬৭৮ জন গেছেন কাতারে। বাকি শ্রমবাজারের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ১২ হাজার ৯৩১ জন, মালয়েশিয়ায় ৩ হাজার ৫, ওমানে ৬৪২ ও সিঙ্গাপুরে ৬৭ হাজার ৬৯০ জন।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিন্ডিকেট বাণিজ্য বন্ধ থাকায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার প্রত্যাশা করেছিলেন দেশটিতে যেতে আগ্রহী কর্মীরা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল চলতি বছরের মে মাসে মালয়েশিয়া সফর করেন। সে সময় তিনি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কেওয়ংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর স্টিভেন সিম চি জানিয়েছিলেন, কয়েক মাসের মধ্যে মালয়েশিয়া এক-দেড় লাখ বাংলাদেশী কর্মী নেবে। কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে বাংলাদেশ—এমন কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘোষণার ছয় মাস অতিবাহিত হলেও চলতি বছর মালয়েশিয়ায় কর্মী গেছেন মাত্র তিন হাজার পাঁচজন। যদিও ২০২৪ সালে দেশটিতে কর্মী গেছেন ৯৩ হাজার ৬৩২ জন।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের কর্মী গমনে একসময় দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। এ বাজারেও দুই বছর ধরে কর্মী যাওয়া কমেছে। ২০২৩ সালে দেশটিতে যেখানে কর্মী গেছেন প্রায় লাখের কাছাকাছি, সেখানে চলতি বছরে গেছেন মাত্র ১২ হাজার ৯৩১ জন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সৌদি আরবকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে বলে মনে করছে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)। তারা বলছেন শীর্ষ এ বাজারেও এখন কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, বেতনসহ নানা ঝুঁকি বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব (সর্বশেষ কমিটি) ফখরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রমবাজার এখন শুধুই সৌদি আরবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তবে এখানেও ইকামা, বেতন এবং কাজ পাওয়া নিয়ে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের জন্য। রয়েছে নিরাপত্তারও অভাবও। অধিকাংশ কোম্পানিতে ইকামা পান না কর্মীরা। ফলে অনেকে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। যারা কাজ করেন তারাও ঠিকমতো বেতন পান না। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান দরকার ছিল।’
সম্ভাবনাময় যেসব শ্রমবাজার ছিল সেগুলো চালু করার উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশেষ করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও উন্মুক্ত হয়নি।
বৈধ পথে সুযোগ সংকীর্ণ হওয়ায় বেড়েছে অবৈধ পথে অভিবাসন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ‘ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্স (ডিটিএম)’-এর তথ্যমতে, ২০২৫ সালে সমুদ্রপথে ইউরোপ প্রবেশে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২০ হাজার ৪৬২ জন বাংলাদেশী প্রচলিত পথের বাইরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৩০৪ জন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ সরকারের একটি ভালো দিক প্রবাসীদের ভোটাধিকার চালু করা। এর আগের কোনো সরকারকে আমরা রাজি করাতে পারিনি। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হলো। পাশাপাশি দক্ষ কর্মী তৈরিতে উদ্যোগ নেয়া যেত। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার ছিল, সেটি হয়নি। নারী অভিবাসন কমে যাচ্ছে, এটিও উদ্বেগের। অনেক নেতিবাচক প্রচারণার জন্য সমাজেরও দায় রয়েছে। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা নিয়মতান্ত্রিকতা এসেছে কিন্তু এ সিস্টেম পরিবর্তন করে একটি আধুনিক সিস্টেম দাঁড় করানোর বিষয়ে আমি কোনো পরিবর্তন দেখিনি। অবৈধ অভিবাসন বেড়েছে। ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনে বাংলাদেশীরাই বেশি। যদি দক্ষতা থাকত তাহলে এভাবে যেতে হতো না। একদিকে ইউরোপের দেশগুলো কঠিন অবস্থান নিচ্ছে, আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের কর্মীরাও যেতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও প্রস্তুতি দরকার ছিল। দিকনির্দেশনারও প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, সুদান, মিসর, রোমানিয়া ও ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে কর্মী নেয়া বন্ধ রেখেছে মালয়েশিয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার বন্ধ না হলেও গত বছর জুলাই থেকে কর্মী ভিসা ইস্যু বন্ধ রয়েছে। ২০১৯ সালে ৯ হাজার ২৬৬ জন শ্রমিক ইরাকে পাড়ি জমান। তার পর থেকে ইরাকের ভিসা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের অক্টোবরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও ইরাকের মধ্যে যৌথ কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া চলতি বছর মে মাসে প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফরে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ শ্রমিক নিয়োগের কথা জানায় দেশটির সরকার। তবে চলতি বছর গতকাল পর্যন্ত জাপানে কর্মী গেছেন ১ হাজার ৪৭২ জন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়ার সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।