কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

শর্তযুক্ত বিদেশি সহায়তা সমর্থন আর কেন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ [সূত্র : আমাদের সময়, ২৭ মে ২০২৫]

শর্তযুক্ত বিদেশি সহায়তা সমর্থন আর কেন

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসন, পরবর্তীকালে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনীতির চালিকাশক্তি প্রধান খাতগুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলা ও নানান সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ ও ধারকর্জ করতে হয়েছে। এ সাহায্য গ্রহণের সময় খাতভিত্তিক প্রয়োজন ও উপযোগিতার ভিত্তিতে শর্তাদি যথাযথ বিবেচনা ও পরীক্ষা-পর্যালোচনা, যথাসময়ে সুদক্ষতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের দ্বারা দ্রুত রিটার্ন প্রাপ্তির লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং অর্জিত অগ্রগতি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য ছিল, আছে এবং থাকবে। বিদেশি ঋণের সুদের কিস্তি ও রেয়াতকাল শেষে আসল পরিশোধের ক্রমবর্ধমান বোঝা এখন বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের অন্যতম ব্যয় খাত। ক্রমান্বয়ে বিদেশি দায় পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমানে যেসব হার্ডটার্মের, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকৃতির ধারকর্জ করা অব্যাহত ছিল তাতে সামনে দায়দেনা পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ না বাড়লে বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের সহনীয় মাত্রা এক সময়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

 

 

বিদেশি সাহায্য গ্রহণকারী অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার কথা নয়, যদি বিদেশি সাহায্য প্রয়োজনীয় সময়ে গ্রহণ করে উপযুক্ত খাতে দ্রুততার সঙ্গে ব্যয় ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সংসারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে নিজের সীমিত স¤পদকে অধিকতর উপযোগী অবস্থায় পাওয়ার জন্যই তো ঋণ বা সাহায্যের প্রত্যাশী হওয়া। গৃহীত সাহায্য ও ঋণ যদি তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে তথা স্বয়ম্ভর ও উৎপাদনমুখী অবস্থার পরিণতিতে না পৌঁছে দেয় তা হলে এক সময় কর্জের টাকা সুদসহ শোধ করতে হলে তো ত্রাহি মধুসূদন পরিস্থিতির উদ্ভব হবেই, যেমনটি হয়েছে দূরের ও কাছের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ ও অর্থনীতিতে। সাম্প্রতিককালেই গোষ্ঠী, পারিবারিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বেশ কয়েকটি হতভাগ্য অর্থনীতির দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উদাহরণও আছে। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে এমন অবস্থায় পড়েনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র নামে খ্যাত নব্য শিল্পায়িত দেশসমূহ।

 

 

এটা স্পষ্ট যে, ১৯৭২-২০১২ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরে যেখানে মাঃডঃ ৫৭ বিলিয়ন বিদেশি সাহায্য এসেছে, সেখানে বিগত পনেরো বছরে ব্যবহৃত হয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি যার গড়ে ৯৬ শতাংশ ঋণ এবং দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকেই এসেছে। এ সময়ে বহুপাক্ষিক উৎস থেকে প্রাপ্ত ঋণের সুদেও হার ও পরিশোধকাল যথেষ্ট সহনীয় (সফট) পক্ষান্তরে দ্বিপাক্ষিক (জাপান ছাড়া) উৎস থেকে গৃহীত ঋণ চড়া সুদে, পরিশোধকাল সীমিত অর্থাৎ কঠিন (হার্ডটার্ম) শক্ত শর্তের, এগুলো মূলত এবং মুখ্যত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকৃতির। কোনো দেশ অব্যাহতভাবে অনন্তকাল বৈদেশিক সাহায্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। বৈদেশিক সাহায্য-সহায়তা সীমিত সময়ের জন্য গ্রহণ করে নিজেকে স্বয়ম্ভর করে তোলাই শ্রেয়। কেননা সহায়তা সব সময় একই পরিমাণে শর্তে ও ঊৎস থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ওপর সাহায্য-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারতম্য ঘটে থাকে। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত সারা বিশ্ব ছিল দুটি শিবিরে বিভক্ত।

 

 

বাংলাদেশের মতো প্রার্থী দেশের সংখ্যা তখন ছিল গোটা বিশেকের মতো। দুশিবিরেই চাইত এসব উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে। ফলে সাহায্য-সহযোগিতা প্রাপ্তির ব্যাপারে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। ঋণ পেলেও সহজ শর্ত তো ছিলই এমনকি দ্বিপাক্ষিক ঋণ মওকুফও হয়ে যেত। বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণের ক্ষেত্রে শর্ত বা খবরদারিও ততটা ছিল না। নব্বইয়ের দশকে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানে বিশ্ব এখন এক শিবিরের নেতৃত্বে এবং সাহায্য প্রার্থী দেশের সংখ্যাও বেড়েছে। এখন বাড়তি খাতির করার যৌক্তিক কারণ আর নেই। ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিপাক্ষিক ঋণ সহায়তা বেশ ওঠানামা করেছে এবং এমনকি বহুপাক্ষিক ঋণপ্রাপ্তিও দুরূহ হচ্ছে, ঋণ অনুমোদন ক্ষেত্রে শর্ত বাড়ছে, খবরদারিও বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পেতে হলে সহজ শর্তের ঋণ মিলবে না, কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে তা শোধ করার সক্ষমতা অর্জন উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য আসন্ন বড় চ্যালেঞ্জ।

 

 

বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তিকে কখনও-সখনও ধারকর্জ করে চলা কোনো কোনো অর্থনীতিতে উন্নয়নের বিশেষ সাফল্য বিবেচনা করে তা ফলাও করে প্রচারের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। আবার সময়ে সময়ে দাতাদেশ ও সংস্থার আরোপিত নানান সংস্কার কর্মসূচির প্রেসক্রিপশন পালনেও বৈদেশিক সাহায্য নেওয়ার প্রবণতা, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশি কনসালট্যান্ট দিয়ে দেশের মানবস¤পদের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতাকে বাড়ানোর প্রয়াসের নামে প্রকল্প ব্যবস্থাপনাকে বরং বিদেশি সাহায্যনির্ভর ও আরামপ্রিয় করে তোলার আত্মঘাতী অবস্থা উপযুক্ত পর্যালোচনায় আনা হয় না। যেহেতু যে কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণ অনুদানের দায়ভার বহন করতে হবে রীতিমতো তিন জেনারেশন পর্যন্ত সব সাধারণ নাগরিককে সেহেতু বৈদেশিক সাহায্য আর কতদিন, কেন, কোন কাজে এবং কী শর্তে নেওয়া হচ্ছে, হবে বা হবে না এসব নিয়ে মিডিয়া এমনকি জাতীয় সংসদে আলোচনা-বিতর্ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণসতেচনতা বৃদ্ধি এবং জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

 

 

 

গণতন্ত্রে মানুষই বড় কথা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই মানুষের কল্যাণভাবনাতেই নিবেদিত। এই মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের দ্বারা, আবার সব মানুষের দ্বারা কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতিসাধিত হয়। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেঁধে দেওয়া আছে কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে বাজার ভারসাম্য বিনষ্ট হবেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে স¤পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে নেতিবাচক মনোভাবের উপস্থিতি, অস্থিরতা ও উন্নয়ন অপারগতার যতগুলো কারণ এযাবৎ চিহ্নিত বা ষনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে এই স¤পদ অবৈধ অর্জন রোধে অপারগতা, ন্যায্য অধিকার বঞ্চিতকরণে প্রগলভতা এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতিই মুখ্য। গণতন্ত্রের বিকাশ ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যা শুভ ও কল্যাণকর নয়। সর্বত্র যৌক্তিক উপলব্ধির অবয়ব মুক্তবুদ্ধির বলয়ে বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভের প্রত্যাশা একুশ শতকে নেতৃত্ব প্রত্যাশী এশিয়ার সব দেশ ও জনগণের জন্য।

 

 

 

দেখা যাচ্ছে কার্যকারণ এর সঙ্গে ফলাফলের আন্তঃযোগাযোগ বা আন্তঃসম্পর্ক পরস্পর প্রযুক্ত ও নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। যে কোনো পর্যায়কে তাই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই, দীর্ঘমেয়াদে অর্জিত সাফল্যকে একটি সীমাবদ্ধ সময়ের অবয়বে শুধু নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখার, প্রচারের ও প্রগলভতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সামষ্টিকতার সামষ্টিকতাই থাকে না যদি কজ আর ইফেক্টের মধ্যকার পরস্পর প্রযুক্ততার বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে নৈব্যক্তিক বিশ্লেষণে যাওয়া না হয়, যদি শুধু খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখা হয় একটি সম্পূর্ণ বিষয়কে। অর্থনীতির ক্ষতিকর যে কোনো অপপ্রয়াস এর সামনের ও নেপথ্যের উভয় কারণ এর প্রতি দৃষ্টিদান সমাধান প্রত্যাশা ও প্রয়াসকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারে। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভব হয় না। শুধু উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা উপস্থাপিত ফলাফলকে সমালোচনার কাঠগড়ায় না এনে একই সঙ্গে কী কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব কিংবা এই ফলাফলের উপলক্ষকেও বিচার-বিশ্লেষণের আর্জিতে আনার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ হলেই যে কোনো ফলাফলকে নানান অবয়বে উপস্থাপন ও সমালোচনা চলে। তার দাবি, প্রয়োজন ও চাহিদামতো পুষ্টিকর খাবার না পেলে কোনো শিশু ক্ষুধায় কাঁদলে, হাত-পা ছুড়ে একাকার করতে থাকলে তাকে ‘কাঁদুনে শিশু’ বলে অপবাদ দেওয়ার অপপ্রয়াস নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত।

 

 

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের বা কর্তৃত্বের হতে পারে না। এর সঙ্গে সবার সংঘবদ্ধ অথচ স্ব স্ব দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের ওপর নির্ভরশীলতাকে মানতেই হবে। সুতরাং সামগ্রিক অবয়ব দেখেই বিচার করতে হবে সব ফলাফলকে। সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতায় প্রধান সীমাবদ্ধতা এখানে যে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অবস্থান করেই দ্বীপপুঞ্জের সাফল্য ও কল্যাণ কামনা করা হয়। সবার সাফল্য শুধু নিজের বলে জাহির আবার নিজের ব্যর্থতাকে অন্যের ওপর চাপানোর মানসিকতা সব সমন্বয় ও সাযুজ্যকরণকে বাধাগ্রস্ত করে। পরস্পরের দোষারোপের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ চেতনা বিকাশ লাভ করে না, সবার প্রয়াস একসুরে বাধা যায় না, হয় না। উন্নয়নের তানপুরায় বারবার ধূলি জমে আর সেখানে ঐকমত্যের সুর সাধা বেসুরো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

 

 

 

চুয়ান্ন বছর বয়সী বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে সময়ের অবসরে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। পরস্পর প্রযুক্ত সাহায্য-সহযোগিতা যেমন একে বলবান হতে আবার আত্মঘাতী পদক্ষেপের দ্বারা অগ্রযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাড় করাতে পারে। এ সাফল্য ও ব্যর্থতায়, আনন্দ ও সর্বনাশে দেশের শিল্পনীতি, সঞ্চয় ও বিনিয়োাগ পরিবেশ এবং পুঁজিবাজারের পথপরিক্রমার সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ সন্ধানে লক্ষ করা যায় এক বিচিত্র গতি-প্রকৃতি।

 

 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক