স্টার্টআপ : বাংলাদেশের সম্ভাবনা, সুফল ও চ্যালেঞ্জ
জোলেখা আক্তার জিনিয়া। সূত্র : আমার দেশ, ২১ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে গত এক দশকে সবচেয়ে আলোচিত ও গতিশীল ধারণাগুলোর একটি হলো ‘স্টার্টআপ’। এটি কেবল একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ নয়, বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি দর্শন। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হলো উদ্ভাবন, প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, ঝুঁকি গ্রহণ ও বিদ্যমান সমস্যার সমাধান নতুন পন্থায় খোঁজা। গুগল, অ্যামাজন, উবার, ফেসবুক কিংবা আলিবাবা—সবকিছুই একসময় ছোট একটি স্টার্টআপ ছিল, যা আজ পৃথিবীর বৃহত্তম করপোরেট জায়ান্টে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশেও বর্তমানে এই ধারণা তরুণদের মাঝে একটি উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কার্যক্রম, তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারা এবং সরকারের উদ্যোগ—সব মিলে একটি নতুন স্টার্টআপ সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে।
স্টার্টআপ কী?
স্টার্টআপ হলো এমন একটি নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগ, যা প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট সমস্যা বা চাহিদার অভিনব সমাধান দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। এ ধরনের উদ্যোগ সাধারণত প্রযুক্তিভিত্তিক হয় এবং সীমিত সম্পদের মধ্যেও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
স্টার্টআপের প্রধান বৈশিষ্ট্য
উদ্ভাবনী চিন্তা : একটি ভিন্নধর্মী ও নতুন সমাধান নিয়ে কাজ করা।
ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা : প্রচলিত নিরাপদ পথে না গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে অজানার পথে যাত্রা করা।
দ্রুত পরিবর্তন ও অভিযোজন : পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা।
স্কেলেবল বা বিস্তৃত হওয়ার ক্ষমতা : স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এ দেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, জনসংখ্যার গঠন, প্রযুক্তিগত প্রসার ও নীতিগত পরিবর্তন স্টার্টআপ খাতে প্রবেশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
১. বিশাল ভোক্তাবাজার : বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। এই বিশাল জনসংখ্যার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে একটি বিপুলসংখ্যক ভোক্তা, যাদের নানা ধরনের চাহিদা আছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা প্রযুক্তিনির্ভর পণ্যের জন্য এক বিশাল বাজার তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ গ্রামাঞ্চলে AgroTech স্টার্টআপ, যেমন iFarmer কৃষকের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বাজার সংযোগ প্রদান করছে।
২. তরুণ জনগোষ্ঠী ও উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা : বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ৩৫ বছরের নিচে। এই তরুণরাই দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী কর্মশক্তি। প্রযুক্তিপ্রবণ, উদ্ভাবনী ও উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছুক এই প্রজন্ম কেবল চাকরির সন্ধান করে না, বরং নিজে কিছু গড়তে চায়। তারা এখন নিজের অ্যাপ বানাচ্ছে, অনলাইন ব্যবসা শুরু করছে এবং ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে। এই প্রবণতাই স্টার্টআপ সংস্কৃতির সূচনা করছে।
৩. প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সুবিধার বিস্তার : বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি। ফোর জি নেটওয়ার্ক, স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা ও ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের (বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) কারণে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা গড়ে তোলা অনেক সহজ হয়েছে। ই-কমার্স খাতে যেমন ‘চালডাল’ বা ‘পিকাবো’ মানুষের দৈনন্দিন পণ্য ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, তেমনি ‘সাজগোজ বা শপআপ’ অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত।
৪. সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা : সরকার ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ নামক ফান্ড চালু করেছে, যার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। আইসিটি বিভাগ, আইডিইএ প্রকল্প, এলআইসিটি প্রভৃতি প্রকল্প তরুণদের উদ্যোগ শুরু করতে সহায়তা করছে।
বেসরকারি ক্ষেত্রেও ‘জিপি এক্সিলারেটর, ওয়াই ওয়াই ভেঞ্চার্স, তরুণ ডিজিটাল, বিওয়াইএলসি ভেঞ্চার্স’ প্রভৃতি ইনকিউবেটর ও এক্সিলারেটর তরুণদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের সুফল
১. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : প্রচলিত চাকরির বাজার সংকুচিত হলেও স্টার্টআপ খাত নতুন চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। একজন উদ্যোক্তা নিজে কাজ শুরু করেও আরো পাঁচ-দশজনের কর্মসংস্থান করতে পারেন।
২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন : স্টার্টআপের মাধ্যমে তৈরি হওয়া পণ্য ও সেবা শুধু দেশের চাহিদা পূরণ করে না, বরং বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এতে রেমিট্যান্স ও বিনিয়োগ উভয়ই বাড়ে।
৩. সামাজিক সমস্যার সমাধান : সামাজিক উদ্যোক্তারা, যেমন ‘মায়া আপা’ নারীস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে, তেমনি ‘জিওন’ নামের স্টার্টআপ স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
৪. নারী ও গ্রামীণ উদ্যোক্তার উত্থান : ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে অনেক নারী এখন ঘরে বসেই অনলাইন বিজনেস করছেন। বিশেষ করে ফেসবুক পেজ, ই-কমার্স সাইট ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে তারা স্বনির্ভর হচ্ছেন।
বাংলাদেশে স্টার্টআপের চ্যালেঞ্জসমূহ
১. প্রারম্ভিক বিনিয়োগের অভাব : বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বা অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের সংখ্যা এখনো সীমিত। ফলে নতুন আইডিয়া থাকা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ অর্থের অভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে না।
২. প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপের অভাব : ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, টিম ম্যানেজমেন্ট, আর্থিক হিসাব, মার্কেট স্ট্র্যাটেজি প্রভৃতি বিষয়ে অধিকাংশ উদ্যোক্তারই অভিজ্ঞতা কম। দক্ষ মেন্টরের অভাব এই ঘাটতি আরো বাড়িয়ে তোলে।
৩. প্রশাসনিক ও নীতিগত জটিলতা : নতুন উদ্যোক্তারা প্রায়ই করকাঠামো, লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও আমদানি-রপ্তানির নিয়মাবলির মতো প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ে যান।
৪. সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি : অনেক সময় উদ্যোক্তাদের পরিবার ব্যবসা শুরুকে ‘চাকরি না পাওয়ার বিকল্প’ হিসেবে দেখে। এই মনোভাব তরুণদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
৫. বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা : স্টার্টআপগুলোর বাজেট কম এবং অভিজ্ঞতাও কম। তাই বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। স্টার্টআপ শুধু একটি ব্যবসায়িক ধারণা নয়, এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের প্রতীক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি হতে পারে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে চাই সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, ইনকিউবেটর ও এক্সিলারেটর সংখ্যা বাড়ানো এবং সামাজিকভাবে উদ্যোক্তার পেশাকে সম্মান জানানো। যদি এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে স্টার্টআপই হতে পারে সেই প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে বাংলাদেশ নতুন প্রজন্মের হাত ধরে অর্থনৈতিক সাফল্যের নতুন ইতিহাস রচনা করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ