কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

শঠ চুক্তিতে ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্তি অসম্ভব

সূত্র : কালবেলা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শঠ চুক্তিতে ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্তি অসম্ভব

চলতি সপ্তাহে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এই তিন বছরব্যাপী ইউক্রেনের নাগরিকরা যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যি অভূতপূর্ব। রাশিয়ার কিয়েভ দখল করার পরিকল্পনাকে প্রতিহত করার পাশাপাশি তারা খারকিভ ও খেরসন অঞ্চলের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে রুশ সৈন্যদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। তবে রাশিয়ার সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ অবিচল থাকলেও, যুদ্ধ এখন এক ক্লান্তিকর অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। দখল হয়ে যাওয়া প্রতি খণ্ড ভূমি পুনর্দখল করতে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। ইউক্রেনের সহ্যশক্তির পাশাপাশি, পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন অব্যাহত রাখার সদিচ্ছারও কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে রাশিয়া।

 

 

এ সংকটপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন ইউক্রেনবিষয়ক নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। হোয়াইট হাউস থেকে দ্রুত শান্তিচুক্তি তৈরি করার প্রস্তাব এসেছে। গত সপ্তাহে সৌদি আরবে মার্কিন ও রুশ প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বিষয় কেন্দ্র করে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনকে এ আলোচনার টেবিলে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ বৈঠকের পাশাপাশি ইউক্রেন বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসির পরিকল্পনা ইউক্রেনের সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা ধারণা করছে যে, উত্তেজনা প্রশমনের নামে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন দ্রুত পরিসরে রাশিয়ার সঙ্গে আপসের ভিত্তি প্রস্তুত করে দিচ্ছে, যার ভুক্তভোগী ইউক্রেনকেই হতে হবে।

 

 

 

যুদ্ধ নিরসনে কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করা উচিত হবে কি না, তা এখন ইউক্রেনের মৌলিক প্রশ্ন নয়। আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি যুদ্ধের সমাপ্তিই আলোচনার টেবিলে ঘটে থাকে। কিন্তু সেই আলোচনার শর্তাবলি কী হবে, তা নিয়েই ইউক্রেনের সরকার এখন বেশি চিন্তিত। দ্রুততম সময়ে যুদ্ধের অবসান ঘটানো যদি মূল লক্ষ্য হয়, তবে সমঝোতার খাতিরে ইউক্রেনের ওপর এমন কিছু শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা নিরাপত্তা সংকটের স্থায়ী সমাধান না করে, শুধু সাময়িকভাবে এ যুদ্ধকে স্থগিত করবে।

 
 
 

সাম্প্রতিক ইতিহাস শান্তি প্রতিষ্ঠার এমন ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করে দেয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ এবং ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিয়ে তা অধিকৃত করে। এর দুই মাস পর রুশ সেনারা স্থানীয় রাশিয়াপন্থি শক্তির সহায়তায় পূর্ব রাশিয়ার দনবাস অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালায় এবং এ অঞ্চলের কিছু অংশে রুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। একই বছরের আগস্ট মাসে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু কিয়েভের ওপর এমন কিছু শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা ছিল বস্তুত তার স্বার্থের পরিপন্থি।

 
 

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। পরের বছর জানুয়ারি মাসে ইউক্রেনভিত্তিক রাশিয়ার সমর্থক বাহিনীর সঙ্গে রুশ সেনাবাহিনী মিলে আবারও ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালায়। বাধ্য হয়ে ইউক্রেনের সরকারকে আবারও আপস করতে হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ভিত্তিতে কিয়েভকে বাধ্য করা হয় রুশ অধিকৃত দনবাস অঞ্চলের দুটি এলাকাকে কার্যত বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে মর্যাদা দিতে।

 

 

মিনস্ক চুক্তিগুলো শেষ পর্যন্ত স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। সংঘাত নিরসনের পরিবর্তে মূলত সাময়িকভাবে যুদ্ধ স্থগিত রাখার জন্য এ চুক্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো অধিকৃত অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করার সুযোগ করে দেয় এবং এ অঞ্চলে ইউক্রেনের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডকে সীমিত করে দেয়। মস্কো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি; বরং কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজের বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেছে এবং যুদ্ধবিরতির সময়কে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিয়েছে।

 

 

কূটনৈতিক পদ্ধতির এ ব্যর্থতাগুলোকে সতর্কতামূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এবং এ অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে সমঝোতার কোনো পথ অবলম্বন করলে তা কোনো দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে না; বরং পরবর্তী সংঘাতকে শুধু সাময়িকভাবে বিলম্বিত করবে। এ দ্বন্দ্বের বাস্তববাদী নিরসন করতে হলে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়—এমন চুক্তিপত্র প্রস্তুত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের দাবিদাওয়া কী, সে সম্পর্কে ইউক্রেনে পরিচালিত জরিপের থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

 

 

তিন বছর ধরে যুদ্ধ স্থায়ী হওয়ায় ইউক্রেনের নাগরিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে গ্যালপ একটি জরিপ পরিচালনা করে, যেখানে তাদের ক্লান্তির স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। ৫২ শতাংশ মানুষ বলছে, যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এখন আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা উচিত। তবে যখন আলোচনার শর্ত হিসেবে ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে, তখন মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ বলে যে, তাদের সরকার এরকম কোনো পদক্ষেপ বিবেচনা করে দেখতে পারে। পরিষ্কারভাবেই ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক শান্তিচুক্তির শর্ত হিসেবে দেশের কোনো অংশ ছাড় দেওয়ার পক্ষপাতী নয়।

 

 

এ পরিসংখ্যান যে অনিবার্য রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরে তা হলো—রাষ্ট্রের সীমানাবর্ধন করার যে অভিলাষ মস্কোর সরকার পোষণ করে, তার বাস্তব রূপ দিতে ইউক্রেনীয় জনগণ রাজি নয়। আলোচনার অংশ হিসেবে ইউক্রেনের সরকার যদি এমন কোনো শর্ত মেনেও নেয়, তবে সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে তারা যে চাপের সম্মুখীন হবে, তা মোকাবিলা করার সামর্থ্য এই মুহূর্তে ইউক্রেনের সরকারের নেই। কাজেই দুই দেশের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের দখল হস্তান্তরবিষয়ক কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

 

 

এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। তারা জানেন যে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে গেলে ইউক্রেনের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা এবং দাবিদাওয়াকে উপেক্ষা করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর প্রতি পশ্চিমা শক্তিগুলোর সমর্থন অব্যাহত রাখা জরুরি। মিত্ররাষ্ট্রগুলোর সমর্থন এবং ইউক্রেনীয় সৈন্যদের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা কত শক্ত অবস্থান নিতে পারবে।

 

 

রাশিয়া যে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে ফাঁদ তৈরি করছে, ইউক্রেন সংকট মোকাবিলা করতে হলে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের সেই ফাঁদে পা দিলে চলবে না। মস্কো যুদ্ধের শুরু থেকেই দাপট দেখিয়ে আসছে; তারা যতটা শক্তিশালী, তার থেকে অধিক শক্তিধর হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে আসছে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য অনেক দেশের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, তাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং তাদের সামরিক শক্তি অদম্য ও অটল—এমনটা দাবি করে আসছে রুশ সরকার। রিয়াদে যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়, সেখানে রুশ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, মস্কোর ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো ঊর্ধ্বমুখী, ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব মূলত পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর পড়েছে।

 

 

রাশিয়া গোটা বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, যুদ্ধ যদি চলমান থাকে তবে তাদের পক্ষে লড়াই করে যাওয়া সম্ভব হলেও, পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর যুদ্ধের যে প্রভাব পড়বে, তা কোনোমতেই প্রশমন করা সম্ভব নয়। তাদের এমন প্রচারণার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই এ ধারণাকে সত্য বলে মানতে শুরু করেছেন। তাই তারা ইউক্রেনের ক্ষতি হবে জেনেও দ্রুত সময়ের মধ্যে শান্তিচুক্তি তৈরি করে রাশিয়ার দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার প্রস্তাব জানাচ্ছেন। বস্তুত এ ধারণা সঠিক নয়। এখন রাশিয়ার দাবি মেনে নিলে তার অর্থ হবে পরবর্তী সময়ে তাকে আরও আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

 

 

ইউক্রেনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র পন্থা হলো, একটি শক্তিশালী যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করা। ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করার মাধ্যমে হোক, দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে হোক অথবা ইউরোপীয় কোনো নতুন নিরাপত্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হোক, ইউক্রেনের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। নতুন শান্তিচুক্তিতে এ প্রতিশ্রুতিগুলো অনুপস্থিত থাকলে, পরবর্তীকালে আবার সংঘাতের দ্বার উন্মুক্ত থেকে যাবে।

 

 

আগামী কয়েক মাস আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসরে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই মুহূর্তে ওয়াশিংটন ডিসি ইউক্রেন বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করছে। যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই নিশ্চয়তার সঙ্গে না বলা গেলেও, এ কথা সত্য যে, ইউক্রেনের লড়াই শুধু তার হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের জন্য নয়, একই সঙ্গে এটা তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। পশ্চিমা নীতি এ লক্ষ্যকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করবে নাকি রাশিয়ার অন্যায় দাবিগুলোর সঙ্গে আপস করতে সম্মত হবে, তার ওপর নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়টা কী রকম হবে।

 

 

লেখক: কিয়েভভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘ট্রান্স-আটলান্টিক ডায়ালগ সেন্টার’-এর সভাপতি। নিবন্ধটি আল জাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ