কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সুদানের গৃহযুদ্ধ যেন এক বৈশ্বিক খেলা

কেরামত আলী [প্রকাশ: সময়ের আলো, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫]

সুদানের গৃহযুদ্ধ যেন এক বৈশ্বিক খেলা

সুদান এক ধ্বংসাত্মক জনপদের নাম। দেশটিতে চলছে দুটি সেনা শক্তির লড়াই। একটি সরকারি সেনাবাহিনী সুদানিজ আর্মড ফোর্স বা এসএএ বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান আর অন্যটি হলো আধা-সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বা SAF-আরএসএফ। এ বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি)। বুরহান ও দাগালো একসময় একে অন্যের সহযোগী ছিল। 

 

 



১৯৮৯ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকা সুদানের সপ্তম প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আহমদ আল-বশিরের উৎখাতে ও ২০২১ সালের অভ্যত্থানে তারা এক সঙ্গে কাজ করেছিল। কিন্তু সুদানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা ও আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে তাদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আর এ দ্বন্দ্বই ২০২৩ সালের এপ্রিলে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। যার ফলে সুদান পতিত হয় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে।

 



সুদানের গৃহযুদ্ধ শান্ত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সুদানে জাতিসংঘ মিশন ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশ ২০২২ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেইতে (UNISFA) একটা ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করে। 

 



কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সুদানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে সুদানের আবেই ঘাঁটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ শান্তিরক্ষীকে হত্যা ও ৮ জনকে আহত করে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও যুক্তরাষ্ট্র এ হতাহতের ঘটনার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে। সুদানের সেনাবাহিনী এ সন্ত্রাসী হামলার জন্য আরএসএফকে দায়ী করেছে।

 



সুদান আফ্রিকা মহাদেশের এক দুর্যোগপূর্ণ মুসলিম দেশ। ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত এ দেশটি প্রায় ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনে সাতটি দেশ বেষ্টিত ও পূর্বে লোহিত সাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠা আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদান যার মধ্য দিয়ে নীলনদ প্রবাহিত। 

 



৫৯৭টি জাতি-গোষ্ঠীর আবাসভূমি সুদানের মানুষ ৪০০টি ভিন্ন ভাষায় কথা বললেও আজো সেখানে ১৩৩টি ভাষা টিকে আছে। ৭০ শতাংশ মুসলিম, ২৫ শতাংশ আদিবাসী ও ৫ শতাংশ খ্রিস্টান অধ্যুষিত সুদানের ভাষা আরবির পাশাপাশি ইংরেজিও তারা ব্যবহার করে থাকে। সুদান আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ। প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ নাগরিকের গড় বার্ষিক আয় মাত্র ৭৫০ মার্কিন ডলারেরও কম।

 



সুদান ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ইসমাইল আল আজহারি। স্বাধীনতার ১ বছর আগে থেকে অর্থাৎ, ১৯৫৫ সাল থেকে চলা এ গৃহযুদ্ধ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে। এভাবে সুদান স্থিতিশীল অবস্থা ১৯৭২-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বিরাজ করে। 

 



১৯৮৯ সালের ৩০ জুন কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সহযোগিতায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটান ও একই বছর ১৬ অক্টোবর ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সুদানে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ, ইসলামি আইন চালু ও গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর একমাত্র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।

 



সুদানের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বাহিনী হলো আরএসএফ। অত্র বাহিনী গঠনের মূল ভূমিকা পালন করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির। দারফুরের নবৎযুদ্ধে বিদ্রোহী দমনে নির্মমতার স্বাক্ষর রাখে ২০১৩ সালে গঠিত কুখ্যাত এই জানজাওয়িদ মিলিশিয়া বাহিনী। 

 



পরে তাদেরকে ‘বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস’-এ রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর অংশ হয়ে ওঠে ও পরবর্তীতে র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) নাম ধারণ করে। জেনারেল দাগালো আরএসএফের প্রধান হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পরে সামরিক সরকারের উপপ্রধান হন। আরএসএফ দ্রুতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইয়ামেন ও লিবিয়ার সংঘাতে অংশ নেয় ও সুদানের স্বর্ণ খনির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

 



২০২৩ সালের এপ্রিল মাস হতে ২০২৫ সালের আজ পর্যন্ত সুদানের গৃহযুদ্ধে আরএসএফ এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, সুদানের সেনাবাহিনী এসএএফ পর্যন্ত তাদের কাছে বিভিন্ন জায়গায় পরাজিত হয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আরএসএফ সুদানের পশ্চিমাঞ্চলে দারফুর ও দক্ষিণ কোর্দোফানের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এখন তারা একটি স্বতন্ত্র সরকার গঠনের দাবি করছে। ফলে দেশটিতে প্রথমে ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদানের বিভক্তির মতো দ্বিতীয়বার আবার বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। 

 



এসএএফকে মিসর ও আরএসএফকে সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থন দিচ্ছে। আমেরিকান-ইসরাইল মিসর ও আরব আমিরাতের মাধ্যমে সুদানের এসএএফ ও আরএসএফ উভয়কেই অস্ত্র সাপ্লাই দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, সুদানের গৃহযুদ্ধ যেন এক বৈশ্বিক খেলা! 

 



সুদানে আরএসএফ কর্তৃক এল ফাশার গণহত্যাটি ২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবর সংঘটিত হয়। যাতে ২৫০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এসএএফ ও আরএসএফের মধ্যে গৃহযুদ্ধে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এক কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভিক্ষ ও মানবিক সংকট। খাবার না পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী ও শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। উভয় বাহিনী সুদানে যুদ্ধাপরাধ করছে। মুসলিম হয়ে মুসলিমদেরকে হত্যা করছে। বিশ্ব অস্ত্র বিক্রি ও স্বর্ণের লোভে নীরব ভূমিকা পালন করছে।

 



সুদানের আরএসএফকে সমর্থন দেওয়া আরব আমিরাতের আল-ধাফরা এয়ার বেজে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮০তম এয়ার এক্সপেডিশনারি ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। যার কারণে  আরব আমিরাত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রে সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে না। আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সুদানে আরএসএফকে সাপ্লাই দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্বর্ণ পাচ্ছে।

 

 

অন্যদিকে, মিসরের সঙ্গে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কারও অজানা নয়। মিসর অস্ত্র দিচ্ছে সুদানের সেনাবাহিনী এসএএফকে। উভয় বাহিনী অস্ত্র পেয়ে সুদানে রক্তের বন্যা বহিয়ে দিচ্ছে। নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রসঙ্গে তিউনিসিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. রফিক আব্দুস সালাম বলেন, সুদানকে আধুবাবির হাতে তুলে দেওয়াটা ফিলিস্তিনকে ইসরাইলের হাতে তুলে দেওয়ার মতোই। যুদ্ধ এক,  কত এক, শত্রু এক এবং সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় তারা ঐক্যবদ্ধ।

 



দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত এখন এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে। বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপে তেল ও স্বর্ণ লুণ্ঠন এখন নিত্য ও নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদানের সামাজিক কাঠামো, অর্থনীতি ও জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়েছে। চারদিকে খাদ্য ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। 

 



ক্ষমতার লোভ, জাতিগত ঘৃণা ও বিদেশি স্বার্থের সংঘর্ষের ফলে সুদান আজ গৃহযুদ্ধসহ উভয় সংকটে ভুগছে। জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, সুদানে এই মুহূর্তে বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় চলছে। যদি যুদ্ধবিরতি না হয় তবে সুদান আফ্রিকার আরেক ‘ভূতুড়ে রাষ্ট্র’ হয়ে উঠবে।

 



ক্ষমতার লড়াইয়ে জেনারেল বুরহান ও দাগালো হয়তো তাদের প্রভাব খাটিয়ে এখনও টিকে আছেন কিন্তু সুদান নামক রাষ্ট্রের ভিত্তি তারা একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। সুদানের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের যে স্বপ্ন দেখেছিল তা আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। 

 



তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা থাকবে, এসএএফ ও আরএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ মিটিয়ে মুসলিম মুসলিম ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক বজায় রেখে সুদান রাষ্ট্র রক্ষার স্বার্থে বিভক্ত হওয়ার হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কিছু ছাড় দিয়ে একসঙ্গে মিলেমিশে দেশটাকে গড়বে ও সুদানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা এ প্রত্যাশায় শান্তি প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় রইলাম।

সময়ের আলো/এআর