কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সুন্দরবনে প্রাণী হত্যা বন্ধ হবে কি

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ০৬ মার্চ ২০২৫

সুন্দরবনে প্রাণী হত্যা বন্ধ হবে কি

সুন্দরবন বাংলাদেশের মায়ের মতন। কেননা যখনই জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে; সুন্দরবন তখনই আমাদের মায়ের মতন বুকে আগলে রেখে রক্ষা করেছে। সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল, ফণি এবং সর্বশেষ আম্ফানেও সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করেছে। এই বন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত সুন্দরবন বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ছয় হাজার ৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ ভারতের মধ্যে। ম্যানগ্রোভ বন নামেও এটি পরিচিত। সুন্দরবনে ১৯৯৬ সালে তিনটি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১২ সালে এখানে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য করা হয়। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালে।

১৯৯২ সালে এটি ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এর আয়তন। বনের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ারভাটা হয় বলে এই বনের গাছপালা বেশ লবণাক্তসহনশীল হয়ে থাকে। এসব বনের প্রধান বৃক্ষ হলো সুন্দরী, গেওয়া, গরান, বাইন, ধুন্দুল, কেওড়া, গোলপাতা। এছাড়া রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রাহরিণ, বানর ইত্যাদি এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রাণী। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতি স্থলজ প্রাণীর বসবাস। এর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী আছে। এখানে প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখির বাস। একটি তথ্যমতে সুন্দরবনে হুমকির মুখে আছে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। এ বনটি উপকূলবর্তী হওয়ায় সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে এটি একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে।

 

 

 

এ সুন্দরবন নানাভাবে আমাদের রক্ষা করে। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমেছে। এটি জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়েছে ৩ থেকে ৪ ফুট। অথচ ১৯৬০ সালের পর থেকে আমাদের দেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার মধ্যে আম্ফান ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। এত দীর্ঘ হওয়ার পরও সিডর বা আইলার চেয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম ছে। কেননা সুন্দরবনে এসেই এ ঝড়ের গতি কমতে শুরু করে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার শঙ্কা থাকলেও সুন্দরবনের কারণে এটি কমে ১০ থেকে ১২ ফুট হয়। ২০০৭ সালে সিডর আর ২০০৯ সালে যে আইলার তাণ্ডব দেখা গেছে বাংলাদেশে, তারও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে সুন্দরবন। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের ভূমিধ্বসের কারণে সুন্দরবনের প্রায় চল্লিশ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা ব্যাপক হতাহতের সাথে সুন্দরবনকে বিধ্বস্ত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ে কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন মতে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন ৪৮৫.২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল। সরকারের বন সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, সুন্দরবন প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় কারণে হুমকির মুখে। অথচ এ সুন্দরবনের ওপর চলছে নানা অন্যায়-অত্যাচার।

 

 

সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ৬২ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধারের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ বন বিভাগ সুন্দরবনের কয়রা উপজেলা থেকে মাংস, মাংস বহনকারী নৌকা জব্দ করেছে। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি। সংবাদে স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, সুন্দরবন এলাকায় প্রায়ই বন্য প্রাণী শিকার ও মাংস পাচারের ঘটনা ঘটে। নিয়মিত অভিযানের পরও এসব বন্ধ করা যায়নি। হরিণ নয়, বাঘ, শূকরসহ অন্যান্য প্রাণীও হত্যা করা হচ্ছে। একটি তথ্যমতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন হরিণ ও দুটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করা হয়েছে।

 

 

বাংলাদেশেও বন্য প্রাণীর অবৈধ ব্যবসার মূল কারণ বন্য প্রাণীর মাংস বিক্রি। এ রকম হরিণের মাংস বিক্রির খবর প্রায়ই পত্রিকায় পাওয়া যায়। বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক একটি সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫১টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে দুটি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। ২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জ অভিযান চালিয়ে শতাধিক হরিণের চামড়া ও মাংস উদ্ধার করেছিল। সুন্দরবেন বিষ দিয়ে মাছও মারা হয়। ধরা হয় কাঁকড়া। বিষ দিয়ে মাছ মারার কারণে জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। সুন্দরবনে ৩১.১৫ ভাগ জলাভূমি। বিষপ্রয়োগের কারণে জলাভূমির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

 

 

বাংলাদেশে বন্য প্রাণী আইন আছে। আইন অনুযায়ী একটি বাঘ বা হাতি হত্যা বা বিক্রির সাজা ও জরিমানা রয়েছে। হাতি বা বাঘের কোনো অংশ পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল অথবা ৩ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।এসব আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। বন্য প্রাণী শিকারি, চোরা শিকারি বা কাঠ শিকারিদের দমন করতে হবে। মানুষের লোভলালসার কারণে সুন্দরবন ধ্বংস হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুয়োগ করা যেতে পারে। পর্যটকের চাপ কমানো দরকার। যে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে, সেই সুন্দরবন তো আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।