স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, দেশের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে
সূত্র : বণিক বার্তা, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি যে এখন সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে তা শিল্পপতিদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে।
নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কয়েক বছর ধরেই স্মরণকালের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা, ডলার সংকট, রিজার্ভের ক্ষয়, বিনিয়োগ খরা, রাজস্ব ঘাটতি, ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও অনিয়ম-দুর্নীতি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের লুটপাট, অব্যবস্থাপনাসহ অর্থনীতি বিভিন্ন সংকটে নিমজ্জমান। গত বছরের আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন পর্যন্ত বেশকিছু বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। বাণিজ্য ও অনুদানের ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে আগামী বছরের নভেম্বরে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে তেমনি সুযোগও তৈরি হবে। তখন আগের পাওয়া সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে না এবং আরো শক্তিশালী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করতে হবে। শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর না করে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও রফতানি পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ অর্থনীতিকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি যে এখন সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে তা শিল্পপতিদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে (এলডিসি) উত্তরণ তিন বছর পেছানো না গেলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধস নামবে বলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা এ মুহূর্তে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। গত এক বছরে দেশের ১০০ গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো ২০০ কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। বর্তমান সরকার টিকফা চুক্তির মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে শ্রম আইন বাস্তবায়নে কাজ করছে।
অথচ জিএসপি দিলেও সেখানে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলে কখনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিরিয়ড তিন বছর পেছানোর দাবি করেছেন তিনি। ২০ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রি: আনলকিং এক্সপোর্ট পটেনশিয়াল’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টাও বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি, এখন এখান থেকে বের হতে পারব না। শিল্পপতি ও সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের অর্থনীতি আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
বাংলাদেশকে এলডিসি তালিকা হতে উত্তরণে চূড়ান্ত সুপারিশ জাতিসংঘ অনুমোদন করেছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে আগামী বছরের নভেম্বরে। তিনটি মানদণ্ডে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অনুকূলে উন্নয়ন সহযোগিতা সম্পর্কিত নীতি-পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিডিপি তিনটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে। সেগুলো হলো মাথাপিছু আয়, জনসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক।
দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ উত্তরণ অবশ্যই চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার। তবে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে অনেক ধরনের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। এক. শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা। দুই. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, নানা ধরনের ছাড়, দীর্ঘ বাস্তবায়ন কাল ইত্যাদি। তিন. আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা।
চার. বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সাহায্য। তাছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের জন্য জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ অনেক কম থাকে, সেটা আর থাকবে না। আইএলও ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হারে বার্ষিক চাঁদা পরিশোধ করতে হবে।
উত্তরণের সরাসরি প্রভাব পড়বে রফতানি বাণিজ্যে। কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে বিশ্ব বাণিজ্যে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারের শুল্ক সুবিধা না থাকলে কেবল পোশাক খাত নয়, সব রফতানি খাত হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাগুলো দ্রুত শুরু করা উচিত। বাংলাদেশের বাণিজ্য সহযোগীদের সঙ্গে এখন থেকেই আলাপ-আলোচনার মধ্যে যাওয়া দরকার। যেমন ২০২৬ সালের পরে আমরা কী কী পণ্য রফতানি করব, তার ওপর শুল্ক কাঠামোটা কী হবে তা ঠিক করতে হবে।
বাংলাদেশকে একটি প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোর মধ্যে চলে যেতে হবে। তা মোকাবেলার জন্য ২০২৬ সালে গিয়ে চিন্তা করলে হবে না। আরো আগেই চিন্তা করা দরকার ছিল। এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে যে কীভাবে আমরা রফতানি বৈচিত্র্যকরণ ঘটাতে পারি। রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের রফতানি গুটিকয়েক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। তৈরি পোশাক ছাড়া পাট, চামড়া ও চা প্রভৃতি পণ্যের রফতানি তেমন উল্লেখজনক নয়। কারণ নীতিসহায়তা ও সক্ষমতার অপ্রতুলতা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। জ্বালানির দামও বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এ মুহূর্তে ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাস করতে না পারলে আমাদের উদ্যোক্তারা সক্ষমতা হারাবেন। দীর্ঘমেয়াদি নীতিসহায়তা প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আশ্বাস বাড়ালে দেশী বিনিয়োগ বাড়বে।
তৈরি পোশাক, ওষুধ, চামড়া ও পাদুকা, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, পাট ও পাটপণ্যের মতো শিল্পগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল, হালাল পণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। সম্ভাবনাময় খাতগুলোর বিকাশে ক্রেডিট ইন্স্যুরেন্স, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন প্রভৃতি থেকে ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে ব্যাংকগুলোর আরো এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
এছাড়া কোনো কারণে যদি বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পের চাহিদা কমে যায় বা ধস নামে তাহলে কিন্তু আমাদের রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এরই মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী আয় আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কোনো কারণে যদি মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে ভাঙন দেখা দেয়, তাহলেও আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। সত্তর কিংবা নব্বইয়ের দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছিল। আমাদের যাতে ওই ভঙ্গুরতার মধ্যে পড়তে না হয় তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সুযোগও তৈরি হবে। তবে সেগুলো মোকাবেলার জন্য আমাদের যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য। নীতিসহায়তা ও সংস্কার, অর্থায়ন, লজিস্টিক খাতের উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি এবং আর্থিক খাত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ যত সহায়ক হবে রফতানি খাতে তত বেশি সাফল্য আসবে।
সেই সঙ্গে শুল্কহার বেশি থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ব্যাহত হয়, তাই সহায়ক রাজস্ব নীতিমালার কোনো বিকল্প নেই। রফতানিমুখী শিল্পের জন্য স্বল্প সুদে অর্থায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে একটি সহায়ক বিনিময় হার নির্ধারণ করার ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে প্রস্তুতির জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সময় নেই।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত মুদ্রানীতির কার্যকারিতা এখনো বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে আরো সচেতন হতে হবে। বাণিজ্যবিষয়ক লজিস্টিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে, যার উত্তরণ অপরিহার্য। এ মুহূর্তে এলডিসি উত্তরণ আমাদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।