‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ প্রতিরোধে যা করতে হবে
সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চলতি পথে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গুরুতর দিক হচ্ছে রাসায়নিক বস্তুর অপব্যবহার। তেমনই এক মারাত্মক ড্রাগ হলো ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস। অপরাধী চক্রের এই ড্রাগ ব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে এক আতঙ্ক তৈরি করেছে। এর ভয়াবহ প্রভাবে ভুক্তভোগী কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই দুর্বৃত্তদের সহজ শিকারে পরিণত হন।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস মূলত স্কোপোলামাইন নামক একটি রাসায়নিক বস্তু। এটি প্রয়োগের মাধ্যমে মস্তিষ্ক বিভ্রম ঘটিয়ে ভুক্তভোগীর সর্বস্ব লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান এই বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে জনসচেতনতা। ডেভিলস ব্রেথ ও স্কোপোলামাইন নামের রাসায়নিক ব্যবহার করে দুষ্কতকারীদের হামলা এড়াতে করণীয় বিষয়ে বার্তা সংস্থা ইউএনবি সবিস্তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
নাইটশেড গোত্রভুক্ত উদ্ভিদের (যেমন রাজঘণ্টা, ধুতুরা) পাতা থেকে ট্রোপেন অ্যালকালয়েড নামক এক ধরনের শক্তিশালী জৈব যৌগ পাওয়া যায়। কথিত আছে প্রাকৃতিকভাবে উৎসারিত এই নির্যাসটি মানুষকে জোম্বি বা জিন্দা লাশে পরিণত করে। আর তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্কোপোলামিন নামে অভিহিত এই রাসায়নিক বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে।
এই রাসায়নিকের রয়েছে অ্যান্টিকোলিনার্জিক বৈশিষ্ট্য। এটির প্রভাব মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর পারস্পরিক বার্তা আদান-প্রদানের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই এটি অতি অল্প মাত্রায় মোশন সিকনেস এবং অত্যধিক বমির চিকিৎসায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে পরিমিত মাত্রায় আরোগ্য দানকারী এই ওষুধই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিষ হয়ে ওঠে। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্ক বিভ্রম, হ্যালুসিনেশন এবং দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা। এমনকি এর মাত্রাতিরিক্ত সেবনে চরম পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট, হার্ট-অ্যাটাক এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্কোপোলামিনের ব্যাপক অপব্যবহার দেখা যায় নানামুখী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। খাবার, পানীয় বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। মস্তিষ্ক বিভ্রমের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিলুপ্তি ঘটে। বিভ্রান্তিটা কেটে যাওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি আগের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই মনে করতে পারেন না। গন্ধ ও স্বাদ কোনোটাই না থাকায় এই রাসায়নিক পদার্থটি তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করারও উপায় থাকে না।
সামগ্রিক কারণে চোর ও ছিনতাইকারীদের ভয়ানক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে স্কোপোলামিন। দুষ্কৃতকারী খাবারে মিশিয়ে অথবা মুখের ওপর এর গুঁড়ো ফুঁ দিয়ে জনসাধারণকে আক্রান্ত করে। অনেকে অপরিচিতদের সাহায্য আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের বাড়িয়ে ধরা কাগজ চোখের কাছে নিয়ে পড়তে গিয়েও ধরাশায়ী হন। এরপর তাকে যা করতে বলা হয় কোনো ধরনের দ্বিধা না করে তা-ই অনুসরণ করেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ঘটনাটি আশেপাশের লোকেদের মনেও কোনো সন্দেহের উদ্রেক করে না। এভাবে কোনোরকম বল প্রয়োগ ছাড়াই অসহায় ব্যক্তিটির সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়।
বাঁচার ১০ উপায়
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস মূলত স্কোপোলামাইন নামক একটি রাসায়নিক বস্তু। এটি প্রয়োগের মাধ্যমে মস্তিষ্ক বিভ্রম ঘটিয়ে ভুক্তভোগীর সর্বস্ব লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান এই বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে জনসচেতনতা। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
অপরিচিতদের দেওয়া খাবার গ্রহণ না করা : বিভিন্ন গণপরিবহন, যাত্রী ছাউনি, পার্ক, রেস্তোরাঁ ও আবাসিক হোটেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এগুলোতে পরিবেশিত কোনো একটি খাবারে মেশানো থাকতে পারে ভয়াবহ স্কোপোলামিন। এসব জায়গা বাদেও যেকোনো অযাচিত খাবারের সুযোগ ভদ্রতার সঙ্গে ফিরিয়ে দেওয়া যৌক্তিক। ফেরিওয়ালার খাবারও এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা সেই বিক্রেতা যেকোনো দুষ্কৃতকারী চক্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
খাবার বা পানীয় উন্মুক্ত না রাখা : কোথাও খেতে বসে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য কোথাও যাওয়ার সময় খাবার উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা উচিত নয়। আশপাশেই ঘাপটি মেরে থাকা কোনো দুর্বৃত্তের জন্য এটি হতে পারে সুবর্ণ সুযোগ। ফিরে এসে হয়তো খাবার সেই আগের স্থানেই পাওয়া যাবে, কিন্তু তা আগের মতো বিশুদ্ধ না-ও থাকতে পারে। তাই একা হলে নিজের কেনা বা সঙ্গে করে বহন করা খাবারটি সর্বদা সঙ্গে রাখতে হবে। সঙ্গী থাকলে তখন কোথাও যেতে হলে খাবার তার দায়িত্বে রেখে যাওয়া যেতে পারে।
অপরিচিতের বাড়িয়ে ধরা কাগজ থেকে সাবধান : প্রতারক চক্রের অনেকে আইডি কার্ড, প্রেসক্রিপশন বা সাদা কাগজে লেখা ঠিকানা জানতে চেয়ে সাহায্য চাইতে পারে। সাহায্য করতে উদ্যত হয়ে কাগজটি চোখের কাছাকাছি নিলেই বিপত্তি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে যাবে বিপজ্জনক মাত্রার ডেভিলস ব্রেথ। তাই নিজের নিরাপত্তায় এ ধরনের অনুরোধ এড়িয়ে চলতে হবে।
বিক্রেতাদের ফুলের সুবাস নেওয়া থেকে বিরত থাকা : ডেভিলস ব্রেথ অন্যান্য ফুলের সঙ্গে মিশিয়েও শিকারের ওপর প্রয়োগ করা হতে পারে। কেননা এই রাসায়নিকের নিজস্ব কোনো গন্ধ নেই। যানজট অথবা পার্কের মতো জায়গাগুলোতে প্রায়ই ফুল বিক্রেতার আনাগোনা থাকে। এদের কাছ থেকে ফুল কেনার সঙ্গে সঙ্গেই তার সুবাস নেওয়া ঠিক নয়। বরং এ ধরনের স্থানগুলোতে এদের এড়িয়ে চলাই উত্তম। ফুটপাত বা ভ্রাম্যমাণ আতর বা পারফিউম বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।
চলতে-ফিরতে সর্বদা মাস্ক পরা : করোনা মহামারির সময়ের মতো সার্বক্ষণিক মাস্ক পরে চলা কার্যকর একটি সুরক্ষা পদ্ধতি। পোর্টেবল এয়ার পিউরিফায়ার মাস্ক বায়ুবাহিত যেকোনো টক্সিনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মাস্কগুলোতে থাকা ফিল্টার বাতাসকে পরিশোধিত করে সুস্থ শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করে।
সঙ্গে স্যানিটাইজার রাখা : স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপত্তি এড়ানো যেতে পারে। কোভিড-১৯ চলাকালীন সবার মধ্যেই ঘন ঘন হাত স্যানিটাইজ করার অভ্যাস চালু হয়ে গিয়েছিল। স্কোপোলামিন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। কোনো কিছু স্পর্শ করার পর হাত স্যানিটাইজ না করে অন্য কাজ করা যাবে না। যাদের মধ্যে ঘন ঘন নাক-মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য এই সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি অতি গরমের সময় অতিরিক্ত ঘাম মোছার জন্যও মুখমণ্ডলে স্পর্শ করার দরকার পড়ে। এ পরিস্থিতিতে একটি পকেট স্যানিটাইজার হতে পারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কবজ।
টাকা লেনদেনের পর হাত স্যানিটাইজ করা : দৈনন্দিন কাজে ঘন ঘন হাত বদল হওয়ার জন্য টাকা-পয়সা হতে পারে স্কোপোলামিন পরিবহনের সহজ মাধ্যম। তাই লেনদেনের পর সবসময় হাত ভালোভাবে স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। বিশেষত জনাকীর্ণ এলাকায় এই সচেতনতা অবলম্বন জরুরি। যাদের মধ্যে জিহ্বায় আঙ্গুল ভিজিয়ে টাকা গোনা বা বইয়ের পাতা উল্টানোর প্রবণতা রয়েছে তাদের ডেভিলস ব্রেথে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক। তাই যেকোনো মূল্যে ঘন ঘন মুখমণ্ডল স্পর্শ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক।
ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অপরিচিতদের নাগালের বাইরে রাখা : কেবল অপরিচিতদের দেওয়া জিনিস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেই হবে না। সে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে নিজের জিনিসপত্রও যেন তাদের নাগালের বাইরে থাকে। নিজের কেনা খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ, মানিব্যাগ, মোবাইল ফোনসহ প্রতিটি জিনিস সযত্নে রাখতে হবে।
সরবরাহকৃত স্প্রে জাতীয় পণ্য ব্যবহারে সাবধান : বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও আবাসিক হোটেলগুলোতে মশা নিরোধক বা এয়ার ফ্রেশনার সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে মানহীন হোটেলগুলোতে থাকার ক্ষেত্রে এ জাতীয় স্প্রেগুলো ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। ট্যাক্সিতে ওঠার পর গাড়ির দুর্গন্ধ দূর করার জন্য ড্রাইভার এয়ার ফ্রেশনার বের করতে পারে। এর বদলে গাড়ির জানালা খুলে বাতাস চলাচলের পথ তৈরি করে দিতে হবে।
অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা অগ্রাধিকার দেওয়া : যাতায়াতে অ্যাপভিত্তিক রাইডগুলোতে আগে থেকেই ড্রাইভারের নাম, ছবি ও গাড়ির বিশদ বৃত্তান্ত দেখে নেওয়া যায়। পরবর্তীতে সঠিক গাড়িটি যাচাইয়ের জন্য প্লেট নম্বর মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া গণপরিবহনের অত্যধিক ভিড়ে ক্ষতিকর স্পর্শের আশঙ্কাও এখানে থাকে না।
তবে অ্যাপে ড্রাইভার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ইতিবাচক হওয়ার পরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এজন্য গাড়িতে ওঠার আগেই পরিচিতদের সঙ্গে রিয়েল-টাইম লোকেশন শেয়ার করে রাখতে হবে। একা হলে ড্রাইভারের পাশের সিটে না বসে পেছনের সিটে বসতে হবে।
মোট কথা, স্কোপোলামাইন নামক রাসায়নিক বস্তুটির শিকার হওয়া এড়াতে নিজের চারপাশের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর জন্য রাস্তাঘাটে চলাচলে অপরিচিতদের দেওয়া খাদ্য, পানীয়, কাগজ গ্রহণ না করা এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সযত্নে নিজ দায়িত্বে রাখা অপরিহার্য। যাতায়াতের পুরোটা সময় মাস্ক পরিধান, সঙ্গে পকেট স্যানিটাইজার রাখা জরুরি। উপরন্তু, রাইড-শেয়ার অ্যাপ ব্যবহার ও আবাসিক হোটেলে স্প্রে ব্যবহার এড়িয়ে চলা এই সমস্যা মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।