কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন: ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে অপচয়ের প্রকল্প

আরিফুর রহমান । সূত্র : প্রথম আলো, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন: ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে অপচয়ের প্রকল্প

তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আট জেলায় একটি করে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় এক থেকে পাঁচ একর পর্যন্ত। তবে এত বেশি জমির প্রয়োজন ছিল না। এতে জমি অধিগ্রহণে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর প্রতিটি ছয়তলা ভবন। এগুলো এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ভবনগুলো দোতলা হলেই যথেষ্ট ছিল। এতে বাড়তি ব্যয় হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। প্রশিক্ষক ও জনবল না থাকায় ভবনগুলোর ব্যবহার নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা।

 

 

আট জেলায় ‘আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (২য় সংশোধনী) প্রকল্পে’ জমি অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণে এমন বাড়তি খরচের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি। প্রায় ৫৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই আট প্রশিক্ষণকেন্দ্র আগামী জুন মাসে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের কথা।

 

আইসিটি খাতে গত সাড়ে ১৫ বছরে বহুমাত্রিক লুটতরাজ হয়েছে। বিগত সরকার এ খাতে আকর্ষণীয় স্লোগান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর কথা বলেছে। বাস্তবে এ খাতে বিপুল বিনিয়োগ কাজে আসেনি।

 

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হুমায়ুন কবীর গত ৫ মার্চ প্রথম আলোকে জানান, এক বছর আগে তিনি এ প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেন এত জমি অধিগ্রহণ করা হলো এবং কেন ছয়তলা করে ভবন নির্মাণ করা হলো, ওই সময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন। তবে বাড়তি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে তাঁর চোখে পড়েছে।

 

 

তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের বিষয়ে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০২০ সালে। ৮৩৭ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ১৪ জেলায় আইটি প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পেও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভূমি অধিগ্রহণ ও ভবনে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৫২ কোটি টাকা। অপ্রয়োজনীয় খাতের ব্যয় বাদ দিলে ৭৪ কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

 

 

শুধু এ দুই প্রকল্প নয়, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে (২০০৯-২০২৪ সাল) তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের চলমান ও শেষ হওয়া আরও ১৯টি প্রকল্পে টাকা অপচয়ের বিষয় জানতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। কোথাও কেনাকাটায়, কোথাও ওয়েবসাইট তৈরিতে, কোথাও একাডেমি প্রতিষ্ঠার নামে, কোথাও জমি অধিগ্রহণ, কোথাও বা ভবন নির্মাণের নামে বাড়তি খরচ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগের মেয়াদে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি। আইসিটি খাতের অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ সমমানের অর্থনীতির দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে।

 

 

আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে আইসিটি বিভাগের চলমান ও শেষ হওয়া প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করতে গত ২৮ আগস্ট ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি বর্তমানে বাণিজ্যসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতিবেদন আইসিটি বিভাগে জমা দিয়েছেন। এসব প্রকল্পে অসংগতিসহ নানা বিষয় প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

 

 

আইসিটি বিভাগের তথ্যমতে, ২১টি প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাঁচজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, মোস্তফা ফারুক মোহাম্মেদ, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, মোস্তাফা জব্বার ও জুনায়েদ আহ্‌মেদ পলক।

 

 

প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি দেখতে পেয়েছে, কোনো কোনো প্রকল্পের এমন কার্যক্রম ছিল, যার সঙ্গে প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মিল নেই। চলমান প্রকল্পে এসব অপ্রয়োজনীয় খাত বাদ দিতে বলেছে তদন্ত কমিটি। আবার কোনো কোনো প্রকল্পে এমন কিছু কাজ রাখা হয়েছে, যা আইসিটি বিভাগের আওতায় পড়ে না। অপ্রয়োজনীয় সব খাত বাদ দিলে ৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

 

আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী গত ৫ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম থাকায় আমরা তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছি। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তারা দেখছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে বেশ কিছু খাতে খরচ কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। আমরা সে আলোকে কয়েকটি কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’

 

প্রশিক্ষণকেন্দ্র হচ্ছে, প্রশিক্ষক নেই

১৪ জেলায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করতে ২০২২ সালে একটি প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের আওতায় ১৪ জেলা সদরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।

 

 

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৪ জেলা সদরের কথা বলা হলেও পাঁচ উপজেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র হচ্ছে। উপজেলাগুলো হলো টাঙ্গাইলের মধুপুর, ফেনীর পরশুরাম, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঢাকার নবাবগঞ্জ। বাকি ৯টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র হচ্ছে জেলা সদরে। তদন্ত কমিটি বলছে, উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের যৌক্তিকতা নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় এগুলো করা হচ্ছে। এখানেও প্রশিক্ষকের বিধান রাখা হয়নি।

প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর প্রতিটির জন্য এক থেকে সাত একর পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অথচ এক একর জমিই যথেষ্ট ছিল। সাততলা করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি বলছে, দুই থেকে তিনতলা ভবনই যথেষ্ট। ভবনগুলোতে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ করা না হলে ৪৩৭ কোটি টাকা বাঁচবে। বেশি জমি অধিগ্রহণে ৪১ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

 

৫ আগস্টের পর এ প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ সাইফুল হাসান। তিনি গত ১১ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী সাততলার পরিবর্তে কোথাও তিন, কোথাও চার, কোথাও পাঁচতলা ভবন করা হবে। এ ছাড়া নীলফামারী সদর, শেরপুর সদরসহ পরশুরাম ও কাশিয়ানী প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণকাজ বাতিল করা হয়েছে। এখন নতুন নকশা করতে হবে।

ভারতের ঋণে ১২ জেলায় আইটি পার্ক স্থাপনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। এতে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। তদন্ত কমিটি বলছে, অন্তত চারটি পার্ক নির্মাণের যৌক্তিকতা ছিল না। অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাতিল করলে ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব।

 

 

হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস নামে ওয়েবসাইট

উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া) নামে ২০১৬ সালে ৪৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস নামে একটি ওয়েবসাইট (www.hasinaandfriends.gov.bd) তৈরি করা হয়। বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

তদন্ত কমিটি মনে করে, ওয়েবসাইটটি অপ্রয়োজনীয়। এটি বাতিল করা যেতে পারে। গত ১০ মার্চ চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে ঢোকা যায়নি। আইসিটি বিভাগ বলছে, সেটি বাতিল করা হয়েছে।

 

 

বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর গত ১১ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ওয়েবসাইটটি কাউকে খুশি করার জন্য করা হয়েছিল। এ ধরনের ওয়েবসাইট করতে সাধারণত এক থেকে দুই কোটি টাকা লাগে। এখানে অস্বাভাবিক খরচ হয়েছে।

এ প্রকল্পের আওতায় ডিজিটাল লেনদেন ‘বিনিময় পেমেন্ট’ গেটওয়ের জন্য ৬৫ কোটি টাকা রাখা হয়। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। তদন্ত কমিটি বলেছে, গেটওয়েটি কার্যকর না থাকায় বাকি ২১ কোটি টাকা ফেরত নেওয়া যেতে পারে।

 

 

ব্যাংক, মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও পিএসপির মধ্যে আন্তলেনদেন নিষ্পত্তির সুযোগ দিতে ২০২২ সালে ‘বিনিময়’ নামের নতুন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়। এ সেবার মাধ্যমে একটি অ্যাকাউন্ট দিয়ে বিকাশ থেকে রকেটে অথবা রকেট থেকে এমক্যাশ বা বিকাশে কিংবা ব্যাংকে তাৎক্ষণিক লেনদেন করা যাবে।

 

 

গত ২৯ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মোবাইলে আর্থিক সেবার আন্তলেনদেন পরিচালনার জন্য “বিনিময়” নামে যে প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছিল, সেটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের শেল কোম্পানি। এমএফএসে আন্তলেনদেনব্যবস্থা এগোতে না পারার একটা বড় কারণ, এটি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়া হয়েছিল।’ এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ড আয়োজনের জন্য রাখা ১৯ কোটি টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তদন্ত কমিটি।