তিস্তা সংকট : সম্ভাবনা ও আশঙ্কা
রাজেকুজ্জামান রতন । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৫ এপ্রিল ২০২৫

তিস্তা সিকিমের ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় জন্ম নিয়ে ৪১৪ কিলোমিটার পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। এটি সিকিমের বৃহত্তম নদী, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। এর ১১০ কিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত হলেও ১২৫০০ বর্গকিলোমিটার অববাহিকার জনবসতি ও কৃষি অধ্যুষিত বৃহত্তম অঞ্চলটাই বাংলাদেশে। কিন্তু সমস্ত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে, ভারত একতরফাভাবে পানি নেওয়ার কারণে শুধু তিস্তা নয়, বাংলাদেশের ‘খাদ্য ভাণ্ডার’ বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গ বিশেষত রংপুর অঞ্চল আজ শুকিয়ে মরার উপক্রম হয়েছে। ফলে তিস্তা নিয়ে উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। তিস্তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনার মধ্যে কয়েকদিন আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিং সফর করে এলেন। তার এই সফরেও আলোচনার বিষয় ছিল তিস্তা এবং খবর এলো, মহাপরিকল্পনায় চীনের পুনঃপ্রবেশ ঘটতে যাচ্ছে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমআরপি) চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ পক্ষ স্বাগত জানায়।’
এর আগে ২০১৯ সালের জুন মাসে চীনা কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ (টিআরসিএমআরপি) নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রসর হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। কিন্তু তখন কানাঘুষা চলছিল যে, তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ ও অংশগ্রহণকে ভারত কীভাবে দেখবে। সপ্তাহখানেক পর, ২৮ ডিসেম্বর (২০২৩) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবে ভারতের আপত্তি থাকলে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এগোতে হবে। আমি-ডামি নির্বাচনের পর পরপরই, ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি চীনা রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন।
এর পরপরই দিল্লি সফরে গিয়ে হাছান মাহমুদ ৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের ভোটের পর তিস্তা নিয়ে সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। এরপর জুন মাসে শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই পক্ষের ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ সংক্রান্ত ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল ‘উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মত সময়সীমার মধ্যে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ এ ছাড়া ‘আউটকাম’ তালিকায় বলা হয়েছিল ‘ভারতের একটি কারিগরি প্রতিনিধিদল তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা (সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে) বাংলাদেশ সফর করবে।’ তারপর তিস্তার পানি না গড়ালেও বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে দেশ চলছে। বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব এখন সবচেয়ে তলানিতে আর চীনের প্রভাব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিস্তার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা এবং প্রভাব কেমন হবে, তা বিবেচনার বিষয়।
ভারত তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে বহুদিন ধরেই। তিস্তার উজানে ভারত ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ৫৪টি ফটক বিশিষ্ট গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই বাঁধ দিয়ে প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ লাখ হেক্টর, অর্থাৎ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল করেছে তারা। এসব খাল একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যন্ত পৌঁছেছে; অন্যদিকে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলা পর্যন্ত গেছে। অর্থাৎ, গজলডোবা বাঁধ একটি বিস্তৃত পরিধিতে সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এর ফটক বন্ধ থাকে বলে বাংলাদেশ পানি পায় না। এখন আরও নতুন দুটি খাল খনন করা হচ্ছে, তা এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়নের অংশ। এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ করতে হয়, পদ্মার উজানেও ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভাগীরথী নদীতে। যার ফলে পদ্মা হারিয়েছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে বিরোধ এবং বিতর্ক চলছেই। কিন্তু এই ফারাক্কা দিয়ে পানি অপসারণের একটি উচ্চ সীমা আছে, যার থেকে বেশি পানি নিতে পারবে না। এই সীমাটা হলো ৪০ হাজার কিউসেক। সে কারণেই যে ফিডার ক্যানেল দিয়ে গঙ্গার পানি ভাগীরথী নদীতে নেওয়া হয় তার সক্ষমতা এভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গজলডোবার বাঁধের মাধ্যমে ভারত কর্র্তৃক তিস্তার পানি অপসারণের কোনো উচ্চ সীমা নির্ধারিত নেই। ফলে ভারত বাংলাদেশের কথা কোনোভাবেই বিবেচনায় না নিয়ে, নতুন নতুন খাল খননের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি টেনে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ অঞ্চলে তিস্তা হারাচ্ছে তার বেঁচে থাকার মতো পানি। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে আলোচনা হয় যে, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত, ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ আর ২৫ ভাগ পানি থাকবে তিস্তার নিজের জন্য।
তিস্তা নিজে না বাঁচলে তার অববাহিকার জীববৈচিত্র্য বাঁচবে কীভাবে? এরপর ২০০৭ সালে স্থির করা হয়, ৪০ শতাংশ ভারত, ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ২০ শতাংশ রাখা হবে নদীর জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু চুক্তি না হওয়ায় গজলডোবা থেকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি আসার পরিমাণ শূন্য। মাঝে মাঝে ২০০-৩০০ কিউসেক পানি যা আসে তা তিস্তার নয়, গজলডোবার ভাটির উপনদী থেকে। তিস্তার উজানে ভারত অনেক বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। ভারতের একজন প্রখ্যাত গবেষক গৌরী নুলকার দেখিয়েছেন যে- তিস্তার উজানে এবং এর বিভিন্ন উপনদীর ওপর ভারত আরও প্রায় ১৫টি বাঁধ কিংবা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশ অংশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার কোনো প্রবাহ আর অবশিষ্ট থাকবে না, তা নিশ্চিত। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। অংশীদার এবং ভাটির অংশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া এই আন্তর্জাতিক নদীর ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ ভারত করতে পারে না। নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতিমধ্যেই গজলডোবা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর প্রবাহ শুধু যে ‘ন্যূনতম পরিবেশসম্মত প্রবাহে’র নিচে চলে গিয়েছে তাই নয়, জীবন্ত সত্তা হিসেবে অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
ভারতের সঙ্গে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য জরুরি বিষয় হলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদ-নদীসংক্রান্ত ১৯৯৭ সালের সনদে (কনভেনশনে) স্বাক্ষর করা। কারণ এই সনদে আন্তর্জাতিক নদ-নদীর প্রতি অংশীদারি দেশগুলোর আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে স্বাক্ষর করলে এবং অন্যান্য দেশকে স্বাক্ষর করতে উদ্বুদ্ধ করলে শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে নদ-নদী সম্পর্কে বিরাজমান বিভিন্ন মতপার্থক্য নিরসনে সর্বসম্মত এবং আন্তর্জাতিক ভিত্তি সৃষ্টি হবে। অভিন্ন নদীর পানি পাওয়া এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভাটির দেশের ন্যায়সংগত স্বার্থ এই সনদে স্বীকৃত হয়েছে। ফলে এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই সনদে স্বীকৃত অধিকারগুলো আরও জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারবে। আজকের যুগে যে কোনো রাষ্ট্র তার সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রত্যাশা করে।
ফলে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দেখাতে পারবে যে, তার দাবি যৌক্তিক এবং এতে আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সমর্থন রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ নদ-নদীবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তার দাবিগুলো তুলে ধরে দেখাতে পারবে যে, তার দাবিগুলোর ভিত্তি অনুরোধ বা সদিচ্ছা নয় তা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারাও স্বীকৃত। এসব জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজও কেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদ-নদী সংক্রান্ত ১৯৯৭ সালের সনদে (কনভেনশনে) স্বাক্ষর করেনি, তা মোটেও বোধগম্য নয়। উজানের দেশ হিসেবে ভারত সুবিধাজনক স্থানে আছে। ফলে ভারতের গরজ নাও থাকতে পারে। উজানের দেশ স্বাক্ষর না করলে ভাটির দেশ স্বাক্ষর করতে পারবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই। বাংলাদেশের নদ-নদী কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। অন্যান্য নদ-নদী ও জলাধারগুলোর সঙ্গে এগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যেমন বাংলাদেশের ভেতর তিস্তার ডান তীরে ৭টি এবং বাম তীরে ৫টি শাখা এবং উপনদী আছে। এগুলোর সঙ্গে তিস্তা নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এগুলোকে সংযুক্ত করা হলে তিস্তার বর্ষাকালের প্রবাহ এসব নদী-নালা-খাল দিয়ে সারা অববাহিকায় বিস্তৃত হতে পারবে। শুষ্ক মৌসুমে এই সঞ্চিত পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে। সুতরাং ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের পাশাপাশি বর্ষাকালের পানি ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।
নদী নিয়ে যে কোনো পরিকল্পনা, ভেবেচিন্তে করা উচিত। পানির হিস্যা ভারতের সঙ্গে সমাধানের সঙ্গে এ অঞ্চলের রাজনীতির স্বার্থ জড়িয়ে আছে। সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। জানা গেছে প্রধান উপদেষ্টা চীনের পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ‘কয়েকশ নদী’ ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীনের কাছ থেকে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তাতে এটিকে ‘তিস্তা প্লাস’ পরিকল্পনা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে; কিন্তু রিভারাইন পিপল নামের সংগঠন তাদের গবেষণায় বলছে, মোট আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩টি। এক তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা যদি ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলে; তাহলে সব আন্তঃসীমান্ত নদীতে চীনের সম্পৃক্ততার যে কথা বলা হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল কী হবে? একদিকে বাংলাদেশের জীবন-মরণ সংকট, অন্যদিকে ভারতের প্রতিক্রিয়া, দুটোই বিবেচনা করতে হবে। বন্ধুত্ব আর আনুগত্য এক নয়। আবার বিনিয়োগ যেন ব্যবসানির্ভর না হয়, তা যেন প্রকৃতি-পরিবেশ বিধ্বংসী না হয়, সেদিকেও নজর রাখা দরকার। তিস্তা উত্তরের প্রাণপ্রবাহ। তিস্তা রক্ষায় বিজ্ঞান, বিশেষজ্ঞদের মতামত, তিস্তাপাড়ের মানুষের অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ সবই বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক