তিস্তার কিসসা
বদরুল হাসান । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৫ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় দুটি অবশ্যম্ভাবী ও অমীমাংসিত আলোচ্য সূচি রয়েছে; একটি হলো তিস্তা নদীর পানির হিস্যা এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা। তবে প্রথমোক্ত সমস্যাটার গভীরতা ও তীব্রতা এতটা মারাত্মক যে, দেশের একটা পুরো অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা, মানুষের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। আমরা এক সময় পাকিস্তানের নাগরিক ছিলাম। তখন এ রকম একটা বহুবর্ষজীবী সমস্যা দেখেছি; সেটা হলো কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠান। আলোচনা করতে করতে আলোচকদের কাঁচা চুলে পাক ধরেছে, তারপর সেগুলো উবে গিয়ে টাক বের হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আলোচনা চলমান রয়েছে। আমরা পাকিস্তানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসেছি, কিন্তু জাতিসংঘের রেজুলেশন ৪৭ অনুযায়ী এখনো সেখানে গণভোট অনুষ্ঠান হয়নি, আলোচনাও শেষ হচ্ছে না। তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিয়ন্ত্রণরেখা (Line of Control) দুদেশের মধ্যে কার্যত সীমান্তরেখা হিসেবে কাজ করছে। ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তিতে উভয় দেশ এটিকে একটি কার্যত সীমান্ত হিসেবে গণ্য করতে সম্মত হয়েছে। এখন আমাদের এই বর্ষজীবী সমস্যার বিকল্প কী?
তিস্তার উৎপত্তি পূর্ব হিমালয় থেকে এবং এটা প্রবাহিত হচ্ছে ভারতের সিকিম ও পশ্চিম প্রদেশ এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৪১৪ কি.মি.। যার মধ্যে সিকিমে ১৫১ কি.মি., সিকিম-পশ্চিমবঙ্গে ১৪২ কি.মি. এবং বাংলাদেশে ১২১ কি.মি. পড়েছে। International Centre for Integrated Mountain Development প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ এই নদীর প্লাবনভূমির আওতাভুক্ত। এই নদীর অববাহিকা ৩০ মিলিয়ন বাংলাদেশিকে জীবিকা অর্জনে সহায়তা করে থাকে, যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের বাস দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (Teesta River Project: An Opportunity for Cooperative Diplomacy, by Md. Jahid- Al-Mamun, May, 30, 2024, South Asian Voices)|
এই নদীর উজানে ভারত বাঁধ ও নানা রকমের অবকাঠামো নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার ও নিয়ন্ত্রণ করায় ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা এবং বর্ষা ঋতুতে বন্যার শিকারে পরিণত হচ্ছে। তিস্তার বার্ষিক গড় প্রবাহ প্রায় ৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার হলেও শুষ্ক মৌসুমে (অক্টোবর-এপ্রিল) এর প্রবাহ গড়ে ১,২০০ থেকে ১,৫০০ কিউসেকে নেমে যায়; মাঝে মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ কিউসেকও হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটনভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইফপ্রি’র (International Food Planning and Research, IFPRI) প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিস্তা অববাহিকায় শুকনো মৌসুমে পানিস্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে এখন চালের উৎপাদন ৮.৯০ শতাংশ কম হচ্ছে; ভবিষ্যতে এই কমতির হার ১৪ শতাংশে পৌঁছার আশঙ্কা রয়েছে।
গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটা চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়, যার মধ্যে তিস্তাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পানিবণ্টনে সে চুক্তিপত্রটা ছিল সমতাভিত্তিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন (JRC)। এই কমিশনের মাপজোকের ভিত্তিতে ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানিবণ্টনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতা হয়; সেখানে ভারতের জন্য ৩৯ শতাংশ, বাংলাদেশের জন্য ৩৬ শতাংশ এবং পরিবেশের জন্য ২৫ শতাংশ পানি বরাদ্দ ছিল। ১৯৮৪ সালে এই হিস্যাটা সংশোধন হয় যথাক্রমে ৪২.৫ শতাংশ, ৩৭.৫ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। কিন্তু সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই হিস্যার বিরোধিতা শুরু করে। ফলে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক তৎপরতা সত্ত্বেও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি। ইত্যবসরে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি অস্বীকার করে নিত্যনতুন পানি প্রত্যাহার প্রকল্প চালু করে চলেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পোষ মানাতে পারছে না। এর অর্থ ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি চুক্তির সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
এই পটভূমিতে তিস্তার পানি সমস্যা সমাধানে চীনের সহায়তায় Teesta River Comprehensive Management and Restoration Project (TRCMRP) বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে অন্যান্যের মধ্যে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করা, প্রশস্ততা কমিয়ে আনা, শুষ্ক মৌসুমের জন্য পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙনরোধে উভয় তীরে বাঁধ নির্মাণ করা, উদ্ধারকৃত ভূমিতে রাস্তা ও স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা, সেচের জন্য নানা ধরনের জলবাহী অবকাঠামো নির্মাণ করা, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা প্রভৃতি কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। ফলে দেশের জনমানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রকল্প নিয়ে বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।
কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য ও জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে ভারত চাচ্ছে না যে, চীন এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলুক। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভারত নিজেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়। ভারতের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতের আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্য এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তরিকতা নিয়ে দেশের মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ প্রকল্পে ভারতের একচ্ছত্র অংশগ্রহণ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ভারত কর্র্তৃক আন্তঃদেশীয় নদনদীর পানি প্রত্যাহার নতুন কোনো বিষয় নয়; ভারত স্বাধীনতা লাভের পর পর পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সেচ সংকট তৈরি হয়। এই ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে পাকিস্তান ১৯৬০ সালে ভারতের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি সম্পাদন করে এবং ১১.৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার ধারণক্ষম সংরক্ষণাগার বিশিষ্ট তারবেলা বাঁধ নির্মাণ করে। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সংযুক্ত হয়। ঐ সময় এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংক এই বাঁধ নির্মাণে আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তা প্রদান করে।
চীন তিব্বতের মেডং কাউন্টিতে ইয়ারলাং জাংম্বো নদীতে এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ এই বাঁধের মাধ্যমে বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ২০৬০ সালের মধ্যে নিট শূন্য-কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চীনের এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীটি একটু ভাটিতে গিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করেছে এবং বিশেষ প্রশস্ততা লাভ করেছে। ভারতে নদীটি প্রথমে সিয়াং এবং এরপর ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করেছে। চীনের এই বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য বর্ষা মৌসুমে বন্যা, শুষ্ক মৌসুমে পানির দু®প্রাপ্যতা, নদীর অববাহিকায় জীববৈচিত্র্যের ভঙ্গুরতাকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাছাড়া, বাঁধে জমে থাকা পানির অস্বাভাবিক ওজন ভূমিকম্পেরও কারণ ঘটাতে পারে।
ভারত সরকার এই বাঁধের প্রতিকূল প্রভাব দূর করতে ১৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে অরুণাচল প্রাদেশের সিয়াং নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে (Siang Upper Multipurpose Project)। এখানে ৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখার মতো সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে এবং ১১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর ফলে অনেকগুলো গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা এ প্রকল্পের ঘোর বিরোধিতা করছে (Financial Express, January 26, 2025)।
বিশ্বজুড়ে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে জনরোষ দেখা গেলেও এদেশে এখন বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে; বাঁধের কুফল রুখতে বাঁধ নির্মাণ এখন সবার প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিগত ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ ও ১৮ তারিখে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ তিস্তা পাড়ের আমজনতাকে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার যে লাগাতার কর্মসূচি পালন করল, তা ছিল প্রকৃত অর্থেই অভিনব ও অভূতপূর্ব। কর্মসূচির সেøাগানটাতেও ছিল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা : ‘জাগো বাহে, নদী বাঁচাই’। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি ভারতের প্রতি অনুসৃত তাদের দোদুল্যমানতার নীতি বিসর্জন দিয়ে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে; মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তিস্তা নদীর পানি হিস্যা চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য সাধারণভাবে এবং তিস্তা পাড়ের মানুষের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই প্রকল্পের অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করাও বিশেষ জরুরি। এই নদী রক্ষা কর্মসূচি যেদিন শেষ হয়, সেই দিনই দেখলাম চীনের মান্যবর রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা করতে চীন প্রস্তুত। চীন পরিত্যক্ত স্বৈরাচারের যেমন মিত্র ছিল, তেমনি বিএনপিরও পুরনো বন্ধু; কৌশলগত কারণে চীন দীর্ঘদিন ধরে এদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আর তিস্তার মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তাদের আগ্রহ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে দেখা যাচ্ছে যে, চীনের সহযোগিতায় যে সব বড় প্রকল্প এ যাবৎ সম্পন্ন হয়েছে (কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক প্রকল্প ইত্যাদি) সেগুলোর উপযোগিতা ব্যয়ের সমানুপাতিক নয়। তাছাড়া, তিস্তার জন্য চীন-প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার অনেক সমালোচনা আছে; নদীর গভীরতা বাড়ানোয় শুষ্ক মৌসুমে অববাহিকা অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা, নদীর প্রশস্ততা কমানোয় বর্ষায় খরস্রোতে ভাঙনের শঙ্কা, পানি ধরে রাখায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রভৃতি অন্যতম। এগুলোও বিবেচনার দাবি রাখে।
এ প্রকল্প নিয়ে ভারত বিশেষভাবে সংবেদনশীল; তিন দিকে পরিবৃত এই প্রতিবেশীকেও সহজে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। সব চেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশ, ভারত ও চীন মিলে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতায় এটা সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে পারলে। সম্প্রতি চীন ও ভারত তাদের সীমান্ত নিয়ে কিছু বিরোধ নিষ্পত্তিতে সফল হয়েছে। উপযুক্ত কূটনৈতিক তৎপরতা ও দক্ষতা দেখাতে পারলে এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অসম্ভব কিছু না। এটা সম্ভব না হলে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক কোনো প্রতিষ্ঠান বা একাধিক উন্নয়ন সহযোগী দেশের সহায়তা নিয়ে কনসোর্টিয়াম গড়ার মাধ্যমে এই স্পর্শকাতর কাজটি সম্পন্ন করা যায় কি না, তাও দেখা দরকার। তবে প্রকল্পের জনসম্পৃক্ততা, অর্থনৈতিক ও বাস্তুসংস্থানগত তাৎপর্য, নদী পাড়ের জনমানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন বিবেচনায় এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত দিতে হবে অনতিবিলম্বে, অর্থাৎ জরুরি ভিত্তিতে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক খাদ্য অধিদপ্তর ও কলামিস্ট