কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

তৈরি পোশাক খাতে প্রয়োজন বিশেষ সহযোগিতা

নিরঞ্জন রায় । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৫ মার্চ ২০২৫

তৈরি পোশাক খাতে প্রয়োজন বিশেষ সহযোগিতা

গত সোমবার একটি ইংরেজি দৈনিকে ‘ক্রমাগত কারখানা বন্ধ হতে থাকায় ব্যবসায় আস্থা কমছে’ শিরোনামে উদ্বেগজনক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বিগত সাত মাসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ভয়ংকর অবস্থা, তা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে এবং উদ্যোক্তারা যে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে আছে সে বিষয়গুলো আলোচ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষ, অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ এবং ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়কেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাবসায়িক নেতা।

 
 
সেই সঙ্গে উচ্চ সুদের হার, খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়াকড়ি এবং ব্যাংকের অসহযোগিতার মতো বিষয়গুলো উক্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

 

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের খারাপ অবস্থা নিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এটাই যে প্রথম প্রতিবেদন তেমন নয়। এর আগে কালের কণ্ঠসহ বেশ কয়কটি জাতীয় দৈনিকে দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অবস্থার দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই, উল্টো ক্রমাগত খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

 

 

গত আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকের ধারণা ছিল যে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সরকার পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা খুব সহসাই কেটে যাবে এবং সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি, বরং ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

 

প্রতিবেদনে দেশের সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শোচনীয় অবস্থার কথাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

 

বেশ কয়েকটি বৃহত্ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পোশাক তৈরির কারখানাসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছোট-বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক শ্রমিক। অনেক তৈরি পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রয় আদেশ প্রত্যাহার করে অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বিদেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। বিদেশি ক্রেতারা এমনিতেই বাংলাদেশে গিয়ে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় অবস্থিত তাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে বসে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

 

 

বর্তমান অস্থিরতার কারণে একেবারেই কোনো ক্রেতা যেতে আগ্রহী নয়। এ রকম অবস্থায় আমাদের রপ্তানিকারকরা যে ক্রেতাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে আলোচনা করে ক্রয় আদেশ সংগ্রহ করবে, সেই সুযোগও সীমিত। কেননা অনেকেই নানা কারণে দেশের বাইরে যেতে পারছে না।

 

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের যেকোনো ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব হবে মারাত্মক। প্রথমত, তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে অত্যন্ত শ্রমঘন একটি খাত। এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। একটি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক হচ্ছে দেশের প্রধানতম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যম।

 

 

এই খাত যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে, যা দেশের রিজার্ভের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তৃতীয়ত, তৈরি পোশাক খাত হচ্ছে ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি একটি ব্যাবসায়িক সম্পর্কের ফল। দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে মানসম্পন্ন পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যে সুনাম অর্জন করেছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে, তা মূলত বিগত তিন দশকের ফল। এখন যদি ক্রেতাদের সঙ্গে এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তাহলে সেটি আর খুব সহজে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না এবং সে ক্ষেত্রে বেশ সময় লাগবে। তত দিনে অন্য কোনো দেশের রপ্তানিকারকরা সেই স্থান নিয়ে নেবে।

 

 

 

তৈরি পোশাক রপ্তানির আরো একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে এক বছর আগে থেকে রপ্তানি আদেশ নিশ্চিত করতে হয়। রপ্তানির জন্য সময়, যাকে লিড টাইম বলা হয়, সেটা হয়তো থাকে দুই থেকে তিন মাস। অর্থাত্ রপ্তানির আদেশ বা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) পাওয়ার পর দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু রপ্তানি প্রক্রিয়া, অর্থাত্ ক্রয় আদেশ, মূল্য, রপ্তানির শর্ত, পোশাকের ধরন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে থেকে। যেমন—আগামী গ্রীষ্মকালের জন্য যেসব পোশাক উন্নত বিশ্বে বিক্রি হবে, তার রপ্তানি প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়। তেমনি আগামী শীতকালে বিক্রির জন্য যে পোশাক, তার রপ্তানি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এখনো যদি দেশের তৈরি পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করা না যায় এবং রপ্তানিকারকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে যদি তাদের আশ্বস্ত করা সম্ভব না  হয়, তাহলে তারা আগামী এক বছরের রপ্তানি আদেশ হাতছাড়া করে ফেলবে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়বে পুরো তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর।

 

 

সবচেয়ে বড় কথা ধারাবাহিক ক্রয় আদেশের বিপরীতে রপ্তানির মাধ্যমে তৈরি পোশাক কারখানা টিকে থাকে। যদি ক্রয় আদেশ না থাকে, তাহলে কারখানা একবার বন্ধ হলে এমন বেহাল হয় যে পরবর্তীতে রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেলেও সে কারখানা আর খুব সহজে সচল করা সম্ভব হয় না। এসব কারণেই তৈরি পোশাক সম্পূর্ণ একটি ভিন্নধর্মী রপ্তানি খাত, যার জন্য সব সময়ই বিশেষ সুবিধা এবং নীতি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এমনকি এই খাতকে একটি অত্যাবশ্যক বাণিজ্য খাত হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব এবং অস্থিরতা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমরা যদি চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং এমনকি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে সেসব দেশে এ ধরনের রপ্তানি খাত বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে।

 

 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কহার আরোপের কারণে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। এর প্রভাবে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এক নতুন সংকটে পড়তে বসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব রাজনীতিতে কিছু নতুন চমক, বিশেষ করে ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক প্রথমে আমেরিকার মিত্র উন্নত দেশগুলোর ওপর প্রয়োগ করা এবং আমেরিকা-ইউক্রেন সম্পর্ক আকস্মিক এক নতুন দিকে মোড় নেওয়ায় এই সংকট কিছুটা কেটে গেছে বা স্তিমিত হয়ে পড়তে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে রপ্তানির ওপর উচ্চ শুল্কের খড়্গ হয়তো আপাতত নামছে না। আমেরিকার ব্যবসায়ীদের আরো কিছুদিন বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা তৈরি পোশাক আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে অত্যাবশ্যক পণ্য। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই সুযোগ নিশ্চয়ই আপনাআপনি আসবে না। এই সুযোগ কষ্ট করে ধরতে হবে। আমরা যদি এই সুযোগ ধরতে না পারি, তাহলে সেটি আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না, বরং অন্য কোনো দেশে চলে যাবে। অনেক দেশই এসব সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে।

 

 

পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অতিসত্বর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত থেকে অস্থিরতা দূর করে এখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ খুব দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

 

১. প্রথমেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে বা কারখানা এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

২. ব্যবসায়ীদের, বিশেষভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের সমস্যাগুলো জানা এবং সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।

৩. রপ্তানিকারকদের বিদেশে গিয়ে, বিশেষ করে ক্রেতাদের আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে ক্রয় আদেশ নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া। ৪. রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ বা আধুনিক করা, যেমন—এলসির পরিবর্তে স্ট্যান্ডবাই এলসির মাধ্যমে রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়া।

৫. ব্যাংকঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করা। এবং

৬. খেলাপি ঋণ কঠোর করার বিষয়টি আপাতত সরিয়ে রাখা। কেননা এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জটিল সমস্যা, যা সময় নিয়ে বিশেষভাবে সমাধান করতে হবে। এর বাইরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে আমেরিকা বা লাতিন আমেরিকায় সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খুলে সেখান থেকে ফিনিশড প্রডাক্ট রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। বিষয়টি ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিধায় এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই।

 

 

মোটকথা, অতিসত্বর দেশের তৈরি পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সেই সঙ্গে রপ্তানিকারকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এমনটা করতে পারলে খুব সহজেই এই খাতের সংকট কাটানো সম্ভব হবে। আর এই বিশেষ খাতের সংকট দূর করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে এর প্রভাব দেশের অন্যান্য ব্যাবসায়িক খাতেও পড়বে এবং সেখানেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। আমাদের প্রত্যাশা, দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকার এবং নীতিনির্ধারক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

 

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা