ফিরে এলেন ট্রাম্প। গত নির্বাচনের পর সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ। সমস্ত জরিপের ফল ও ঝানু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণী উল্টে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির মসনদে বসতে যাচ্ছেন। জনপ্রিয় ভোটের হিসাবেও অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি কমলা হ্যারিসকে পেছনে ফেলেছেন। তার জন্য আরও স্বস্তির বিষয় হলো, রিপাবলিকানরা চার বছর পর সিনেটের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে সুপ্রিম কোর্ট ও ফেডারেল কোর্টে নিজের পছন্দমাফিক বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ডেমোক্র্যাটদের বাধার সম্মুখীন হবেন না। দ্বিতীয় মেয়াদে যা ট্রাম্পকে আরও কর্র্তৃত্বপরায়ণ করে তুলতে পারে। রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই উদারপন্থি বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-গণমাধ্যম ট্রাম্পের সমালোচনায় সরব ছিল। তাদের মরিয়া প্রচেষ্টা শেষমেশ সফল হলো না। উদারপন্থি এই শক্তিশালী গোষ্ঠী তবুও আগামী চার বছর ট্রাম্পের বিরোধিতা চালিয়ে যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট পেপ সম্প্রতি ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘আমেরিকা নিঃসন্দেহে একটি পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গরা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থেকে ক্রমশ সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে। উল্কার গতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান এবং এই নির্বাচনে অভিবাসী সমস্যা নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্কের নেপথ্যে রয়েছে জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে শ্বেতাঙ্গদের মনে তৈরি হওয়া আতঙ্ক ও ক্ষোভ।’ এবারের নিবার্চন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। সংশয়ে থাকা ভোটারদের দলে টানতে ট্রাম্প ও হ্যারিস দুজনেই জলের মতো অর্থ ব্যয় করেছেন। মোট ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে হিলারি ও ট্রাম্পের মোট ব্যয় ছিল সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার। কয়েক মাসব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় দুদলের সমর্থকরা গণমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) যেভাবে একে অপরকে লাগামহীন বিষোদগার করেছেন, তাতে মার্কিন সমাজের ফাটলরেখা আরও প্রশস্ত হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব একটি জরিপে উঠে এসেছে, ডেমোক্র্যাট ভোটারদের ৮৬ শতাংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের জন্য ট্রাম্প বিপজ্জনক হবেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান ভোটারদের ৬৭ শতাংশের দৃঢ় বিশ্বাস, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে মার্কিন গণতান্ত্রিকব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। দুদলেরই ৪০ শতাংশের বেশি ভোটারের ধারণা, তাদের পছন্দের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট না হতে পারলে তারা দ্বিতীয় সারির নাগরিকে পরিণত হবেন। বলাই বাহুল্য, নির্বাচনের ফল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা রাতারাতি উবে যাবে না। ২০১৬ সালের নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর পরিচালিত জরিপে এক-তৃতীয়াংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক জানিয়েছিলেন যে, ট্রাম্পের বিজয়কে তারা আইনত অবৈধ মনে করেন। একইভাবে অধিকাংশ রিপাবলিকান ভোটার এখনো বিশ্বাস করেন যে, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পই আসলে জয়লাভ করেছিলেন! রাজনৈতিক এই মেরূকরণ ক্যাপিটল হিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলবে। ঘনীভূত হতে পারে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাও। ডেমোক্র্যাটরা যেসব অঙ্গরাজ্যে সরকার গঠন করবেন, স্থানীয় ভোটারদের তুষ্ট করতে গভর্নররা হোয়াইট হাউজ থেকে ঠিক করে দেওয়া নীতি বাস্তবায়নের গতি শিথিল করতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে তারা কেন্দ্রীয় নীতির প্রয়োগ পুরোপুরি ঠেকিয়েও দিতে পারেন। দেশের ভেতরে যদি এরকম টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বিঘœচিত্তে ছড়ি ঘোরানো মার্কিনিদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ করাটা তাই নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছিলেন। এই কৌশল তিনি এবার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত করতে পারেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ : নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার রানিং মেট জেডি ভ্যান্স দুজনেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রায় তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধ থামাতে তারা রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবেন। গত সপ্তাহে এক পডকাস্টে ভ্যান্স প্রশ্ন তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থরক্ষায় ইউক্রেন আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি না। তিনি এও বলেন, আমেরিকার কাছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে ইউক্রেনের চেয়ে তাইওয়ান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন আক্রমণ করা রাশিয়ার উচিত হয়নি। তবে এই সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে মার্কিন কূটনীতিরও দায় আছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন যে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়েছিল, তাতেও পরিবর্তন আসতে পারে। ন্যাটো বরাবরই দাবি করে এসেছে, পুতিন ইউক্রেন দখল করতে পারলে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হবেন। জেডি ভ্যান্স ন্যাটোর এই দাবি উদ্ভট বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে ঢালাও আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেবে না। মার্কিন জোগান ছাড়া কিয়েভের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে টান পড়বে। তখন যে ঘাটতি সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার সামর্থ্য ন্যাটোর বাকি সদস্য দেশগুলোর নেই। ফলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালানোর সক্ষমতা বহুলাংশে হারাবে। সুযোগ পেয়ে পুতিন যদি আরও আগ্রাসী হামলার নির্দেশ দেন, যুক্তরাষ্ট্রের জোর সমর্থন ছাড়া ইউক্রেন খুব বেশিদিন আত্মরক্ষাও করতে পারবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, টাইম ম্যাগাজিনের ফটোশুটে মডেল হওয়ার কিংবা মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ ট্রাম্পের আমলে আর পাবেন না জেলেনস্কি। বরং আলোচনার টেবিলে বসে আপসের পথ বেছে নিতে তিনি বাধ্য হবেন।
আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ দুটোই শুরু হয়েছিল রিপাবলিকান শাসনামলে। তাই যুদ্ধের ব্যাপারে রিপাবলিকান দলের হঠাৎ অরুচি দেখে কারও কারও খটকা লাগতে পারে। এর পেছনে আছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। এ বছরের এপ্রিল মাসে পলিটিকো ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একাধিক তরুণ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা স্বীকার করেন, আফগানিস্তান ও ইরাকে সরাসরি লড়াই করার অভিজ্ঞতা থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী সমরনীতি বদলাতে চাচ্ছেন। রণক্ষেত্রে মার্কিন সৈন্যদের ব্যর্থতা আমেরিকার সামরিক শক্তি নিয়েই তাদের সন্দিহান করে তুলেছে। বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের ওপর তারা আস্থাও হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের দাবি, অন্য দেশে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘস্থায়ী সামরিক হস্তক্ষেপ করার বদলে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইরাক যুদ্ধ একটি মারাত্মক ভুল ছিল। তৎক্ষণাৎ রিপাবলিকান নেতারা ট্রাম্পের কড়া নিন্দা করেন। ট্রাম্প যে সঠিক ছিলেন তা প্রমাণ হয় ২০১৯ সালে। পিউ জরিপে ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়া ৬৪ শতাংশ মার্কিন সৈন্য মতামত দেন, এই যুদ্ধে জড়িয়ে আমেরিকা ভুল করেছে। রিপাবলিকান দলের তরুণ অংশটি মূলত এদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। মনোনয়ন লাভের লড়াইয়ে তারা ট্রাম্পকে জোরালো সমর্থন দেন। জেডি ভ্যান্স হলেন এদের মুখপাত্র। তিনি নিজেও ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিরোধী রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা ইউক্রেন যুদ্ধে বাইডেনের নীতি বদলানোর যুক্তি হিসেবে বলছেন, ইউরোপে স্থলযুদ্ধ চালানোর সামর্থ্য আমেরিকার নেই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত হতে গিয়ে আমেরিকা তার প্রধান প্রতিপক্ষ চীনের ওপর থেকে নজর সরিয়ে ফেলছে। ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। ট্রাম্প একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে চীনের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। করোনা মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের যুগপৎ প্রভাবে পর্যুদস্ত বিশ্বঅর্থনীতির জন্য আমেরিকা ও চীনের মধ্যে নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ হবে এক অশনি সংকেত।
মধ্যপ্রাচ্য সংকট : গাজা যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকায় বিরক্ত ক্ষুব্ধ বহু আরব-আমেরিকান ও মুসলিম ভোটার এবারের নির্বাচনে কমলাকে সমর্থন দেননি। যদিও রূঢ় বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে ট্রাম্প কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এখনো জানাননি। ভুলে গেলে চলবে না, ২০২৩ সালের গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী ট্রাম্পের দুটো পদক্ষেপÑ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং আব্রাহাম অ্যাকর্ডস। এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার জামাতা ও সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের দূতিয়ালিতে। ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্বাস জাকির পর্যবেক্ষণ হলো, ফিলিস্তিন ইস্যুর সমাধান ছাড়াই আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা ৭ অক্টোবরের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবারও জ্যারেডের তত্ত্বাবধানে থাকবে। তিনি একজন অর্থোডক্স ইহুদি এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুত্ব রয়েছে। ইরান, লেবানন ও হামাস কারও জন্যই এটি সুসংবাদ নয়। তবে ট্রাম্পও জানেন, ২০১৬ আর ২০২৪ এক নয়। বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে মার্কিন প্রভাব ধরে রাখতে প্রয়োজন বিচক্ষণ পদক্ষেপ, ফাঁকা আস্ফালন জোর হারিয়েছে অনেক আগেই।