কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাদানুবাদ ও বাস্তবতা

অ্যারন সোবচাক । সূত্র : যুগান্তর, ০৬ মার্চ ২০২৫

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাদানুবাদ ও বাস্তবতা

এটা কারও জন্যই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, ইউরোপ এবং প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াগুলো গত সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্সের মধ্যে প্রকাশ্যে বিতর্ক নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ অস্ত্র কোম্পানি এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতৃত্ব উভয়ের জন্যই লাভজনক হয়েছে এবং মার্কিন মিডিয়া পুতিনকে একটি বিশেষভাবে দুষ্ট নেতারূপে এবং ইউক্রেনকে জেলেনস্কির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের দুর্গ হিসাবে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে।

 

 

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলোচনা সত্যিই উত্তপ্ত হতে পারে, তবে ঐতিহ্যগতভাবে হোয়াইট হাউজে এ ধরনের ঘটনা সাধারণত বন্ধ দরজার পেছনে হয়ে থাকে। আমেরিকান জনসাধারণ বিদেশি নেতাদের হোয়াইট হাউজে বিশেষ দাবিসহ আসতে দেখে অভ্যস্ত, যেগুলো প্রায়ই উচ্ছ্বাসপূর্ণ সমর্থনের সঙ্গে পূরণ করা হয়।

 

 

এটি বিশেষভাবে সত্য ইউক্রেনের জন্য। ইতঃপূর্বে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়েই ইউক্রেনের জন্য বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছেন, যেখানে বাইডেন ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তাকে ‘শীর্ষ অগ্রাধিকার’ বলেছিলেন। তবে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হওয়ার পর বিশ্বনেতারা এবং প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াগুলো ইউক্রেনের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, যেহেতু দেশটির প্রতি আমেরিকার দৃঢ় সমর্থনের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

 

 

উৎসাহজনক বিষয় হলো, এর আগের সব ব্যর্থতার পরও ট্রাম্প-ভ্যান্স প্রশাসন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং এই ঋণের সুদ পরিশোধে বছরে শতকোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি সম্ভবত ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তদুপরি এ বিষয়ে আগে আমেরিকান জনগণের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে এবং তাদের বেশির ভাগই ইউক্রেনে অবাধ সহায়তা চালিয়ে যেতে চায় না। এমনকি ইউক্রেনের জনসাধারণও একটি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত, কারণ তারা জানে পুতিনকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা সম্ভব নয়।

 

 

 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা আগ্রাসনের ইতিহাস সম্পর্কে মার্কিন জনসাধারণ খুব কমই জানে, যে ইতিহাস বলে, ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণের কোনো বিকল্প মস্কোর ছিল না। এটি বলার অর্থ এই নয় যে, অন্য একটি দেশে আক্রমণ করা ন্যায়সঙ্গত, বরং এটি বলা উচিত যে, উসকানির সম্ভাব্য পরিণতি অনুধাবন করা প্রয়োজন।

 

 

পুতিনের উদ্বেগের যৌক্তিক কারণ থাকার বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, সেই সঙ্গে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিও তিনি মনোযোগ দিয়েছেন। ফলে মিডিয়া তাকে পুতিনের পুতুল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নিজ স্বার্থের কথা মনে রেখেই ইউক্রেনে একটি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন। তিনি কিয়েভের সঙ্গে খনিজ-অ্যাক্সেস চুক্তি থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। যা বেশির ভাগ পেশাদার ব্যক্তি ও মিডিয়া মিস করেছে তা হলো, প্রত্যেক রাজনীতিক দেশ পরিচালনার সময় স্বার্থের কথা মাথায় রাখেন। অস্ত্রশিল্প ইউক্রেনে সহায়তা থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হয়েছে, যেমন হয়েছে ইউক্রেনের অভিজাতরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জেলেনস্কি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় নেতা পাবলিক চয়েসের ক্ষতিকর দিকটি থেকে মুক্ত নন, তারা যখন দেশ শাসন করেন তখনো।

 

 

যদিও রাজনীতিকরা মহৎ উদ্দেশ্য থেকে কাজ করছিলেন, কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, ইউক্রেন বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধে জিতবে না। এমনকি ইউরোপীয় নেতারা এবং জেলেনস্কি নিজেও পুতিনের সঙ্গে শান্তির-বিনিময়ে-ভূমি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ইউক্রেনে আমেরিকান সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছাও নেই এবং বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশ এখনো ইউক্রেনের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ায়নি।

 

 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে, জেলেনস্কির একটি চুক্তির প্রয়োজন, যাতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকে এবং রাশিয়ার কিছু বৈধ রেডলাইন রয়েছে, যা ন্যাটোর অতিক্রম করা উচিত নয়। ট্রাম্প এটিও জানেন, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার আমলে শুরু হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন, যাতে কিছু, যদিও অস্পষ্ট, নিরাপত্তা গ্যারান্টি অন্তর্ভুক্ত থাকে কিয়েভের খনিজ খনিতে প্রবেশাধিকারের বিনিময়ে।

 

 

জেলেনস্কি খনিজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু তার ক্ষোভ তাকে প্রভাবিত করে। তিনি স্পষ্টভাবে পশ্চিমা নেতাদের দ্বারা একজন নায়ক হিসাবে এবং ইউক্রেনকে গণতন্ত্রের দুর্গ হিসাবে আচরণ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই তিনি পুতিনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সম্ভাব্য শান্তিচুক্তি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে সাংবাদিকদের সামনে ট্রাম্প প্রশাসনকে চাপ দিতে চেষ্টা করেন। তার এই পদক্ষেপটি ট্রাম্পের অহংবোধকে অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে মূল্যায়ন করে এবং উভয় পক্ষকেই বিশ্বের সামনে খাটো করে তোলে। তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হন, ওয়াশিংটনকে কোনো চুক্তি ছাড়াই ছেড়ে দেন এবং একটি শান্তি চুক্তি পিছিয়ে দেন। তবে এ ঘটনার উজ্জ্বল দিকটি হতে পারে, জেলেনস্কির অক্ষমতা প্রদর্শনের পর ইউরোপ অবশেষে নিজের প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেবে।

 

 

বাদানুবাদের সময় ট্রাম্প সঠিকভাবেই জেলেনস্কির কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘তুমি কি চাও আমি পুতিনের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলি এবং তারপর তাকে বলি, হে, ভ্লাদিমির, চুক্তির কী হবে?’ এটি একটি ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন। বাইডেন তো পুতিনের সঙ্গে কথা বলতেও অস্বীকার করেন গর্বের সঙ্গে। এভাবে নিশ্চিত করেন, তিনি কখনো ইউক্রেনে শান্তি আনবেন না। তিনি পুতিনকে ‘ক্রেজি সন অব বিচে’র মতো গালিও দেন, যা নিশ্চিতভাবেই মস্কোকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে।

 

 

ইউক্রেনের দুর্ভোগের অবসানে পুতিনের সঙ্গে একটি বাস্তবসম্মত চুক্তির প্রয়োজন, যা ট্রাম্প অন্তত আংশিকভাবে বোঝেন। দায়িত্বশীল মানুষদের উচিত পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়ে শান্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এমনকি এর অর্থ যদি হয় পশ্চিমা শক্তিগুলোকে ইউক্রেনের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ সীমিত করা, তবুও।

মাইসেস ইনস্টিটিউট (mises.org) থেকে ভাষান্তর

 

অ্যারন সোবচাক : যুক্তরাষ্ট্রের কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রিসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিবেদক