কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাকবিতণ্ডা

সুমন আমীন । সূত্র : সময়ের আলো, ১২ মার্চ ২০২৫

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাকবিতণ্ডা

এক নজিরবিহীন বাকবিতণ্ডা প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে তীব্র বিতণ্ডা দেখে বিশ্বের শতকোটি মানুষ স্তম্ভিত। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর ভর করেই ইউক্রেন বৃহৎ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি ও সাবেক সুপার পাওয়ার রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের পক্ষে একা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

 



আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সরাসরি সক্রিয় সহায়তার কারণেই ইউক্রেন তিন বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত দিনে ইউক্রেনকে যুদ্ধ সহযোগিতায় প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। আরও সহায়তার আশ্বাস দিয়ে রেখেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকাকে প্রথম’ বানাতে চাওয়ায় আমেরিকার স্বার্থ সবার আগে নিশ্চিত করতে চান। এমনকি এ স্বার্থ আদায় করতে যদি দীর্ঘদিনের শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতেও হয়, তাতেও পিছপা হবে না ট্রাম্প প্রশাসন।

 



শীতল যুদ্ধকালে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কমিউনিস্ট বলয়ের নেতৃত্বে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়া। তৎকালীন সোভিয়েত বলয় থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন দেশকে পক্ষে টানতে নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। এমনকি নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও এ সহায়তা অব্যাহত রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপকে রাশিয়ার হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে ন্যাটোর মতো সামরিক জোটও গঠন করেছিল তারা। কিন্তু ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে ট্রাম্প তার কঠোর ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘যদি ইউরোপ প্রতিরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যয় না করে, তা হলে ওয়াশিংটন তাদের সুরক্ষা দিতে পারবে না। ৭৫ বছরের পুরোনো ট্রান্স আটলান্টিক জোটের জন্য অন্য সদস্যরা প্রতিরক্ষায় যে ব্যয় করে তা পর্যাপ্ত নয়। তাদের আরও খরচ করা উচিত।’

 

 



ট্রাম্পের কথায় এক আত্মকেন্দ্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেহারা দেখছে ইউরোপীয় দেশগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১৯৪৯ সালে ঘোষণা দেন, ন্যাটো জোটের কোনো দেশের ওপর হামলা যুক্তরাষ্ট্র নিজের ওপর হামলা বলেই মনে করবে। তবে, ট্রাম্পের বর্তমান কার্যকলাপ যুক্তরাষ্ট্রকে এ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনার ইঙ্গিত বহন করছে। আমেরিকার বর্তমান প্রশাসনের মূল লক্ষ্য যেকোনো উপায়ে তাদের কায়েমি স্বার্থ নিশ্চিত করা। তাতে যদি তাদের বন্ধুকে শত্রু, শত্রুকে বন্ধু বানাতে হয় তাতেও পিছপা হবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চাওয়ারই এক জাজ্বল্যমান প্রমাণ। মূলত ট্রাম্পের ক্ষেপে যাওয়ার মূল কারণ হলো জেলেনস্কির সঙ্গে জ্বালানি চুক্তি করতে না পারা। বৈঠকে ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স উচ্চ ও উত্তপ্ত বাক্যে জেলেনস্কিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ এবং ‘অশ্রদ্ধাশীল’ বলে অভিযুক্ত করেন। জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই খারাপ ছিল। গত বৈঠকে যার প্রকাশ্য চিত্রায়ন দেখল পুরো বিশ্ব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, একটি মিথ্যার ওপর ভর করে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে ইউক্রেন। 

 

 



রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্টের বিভিন্ন বিবৃতি ও ভাষণ বিশ্লেষণ করে নিউইয়র্ক টাইমসের ওয়াশিংটন প্রতিনিধি ডেবিড ই স্যাঙ্গার বলেন, ট্রাম্প যা চান, তা হলো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এর জন্য যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হয়, মস্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত খারিজ করতে হয় এবং ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায়ে ঠেলতে হয়। এদিকে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির উত্তপ্ত আলোচনায় মহাখুশি রাশিয়া। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারুভা টেলিগ্রাম পোস্টে লিখেন, ‘ট্রাম্প ও ভ্যান্স কীভাবে সেই বদমাশকে (জেলেনস্কি) আঘাত করা থেকে বিরত ছিলেন, সেটা সংযম প্রদর্শনের এক অলৌকিক ঘটনা।’ কিন্তু জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ইউরোপে কঠোর প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ওভাল অফিসে রাষ্ট্রনায়কের মতো আচরণ করেননি বরং মাফিয়া বসদের মতো আচরণ করেছেন।

 

 

 

ফরাসি দৈনিক লে ফিগারো লিখেছে, ‘আমেরিকাতে এখন একজন জারের খেলা খেলছেন যিনি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভুলছেন এবং পশ্চিমাদের পতন চান।’ যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ লিখেছে, ‘পশ্চিমা ঐক্য এখন অপরিহার্য। এ উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডার ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ব্রিটেন এবং ইউরোপের যে কেউ তাদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাববে।’ সুইজারল্যান্ডের সংবাদপত্র নিউ জুরকার জেইতং লিখেছে, ‘যদি ইউরোপীয়রা সত্যিই ইউক্রেনে টেকসই শান্তি চায়, তা হলে সম্ভবত তাদের নিজেদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে, আমেরিকান আশ্বাসে ভরসায় থেকে নয়।’ আমেরিকার ভরসায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে ইউরোপীয় নেতারাও তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আজ ঐকমত্যে পৌঁছাছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের আহ্বানে লন্ডনে এক বৈঠকে মিলিত হন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা। সেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন থেকে ইউক্রেনের প্রতি সবার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ইউরোপসহ পুরো পৃথিবীর যুদ্ধবিরোধী মানুষও চায় ইউক্রেনসহ গাজা, সিরিয়া, ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ হোক। কিন্তু আমেরিকার ‘ডিক্টেটর’ হতে চাওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার কারণে বিশ্ববাসী আজ আতঙ্কগ্রস্ত। 

 



ক্ষমতাগ্রহণের আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি একদিনের জন্য হলেও ডিক্টেটর হতে চান। ডিক্টেটর হতে চাওয়ার প্রমাণও তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন ইতিমধ্যে। আমেরিকার অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতায় গত দেড় বছরে ফিলিস্তিনের গাজাকে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে মানবতাবিরোধী ইসরাইল রাষ্ট্র। যে ইসরাইল নামক অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোরপূর্বক আরব ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করে। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে ধ্বংসপ্রায় গাজাকে দখলে নেওয়ার খায়েশ প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যা স্বাধীন দেশকে শক্তির জোরে দখল করে নেওয়ার ঘৃণ্য এক অভীপ্সা। ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ওভাল অফিসে হামলা করে ইতিমধ্যে তার রাজনৈতিক চেহারা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছেন। 

 



নতুন করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব বাতিলের নির্বাহী আদেশ জারি করেন। যা মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর বিরোধী। তিনি ইতিমধ্যে হাজার হাজার চাকরিজীবীকে বরখাস্ত করেছেনÑযারা তার নীতির পথে বাধা হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বসহ গরিব পৃথিবীতে আমেরিকার অর্থ সহায়তাসহ ইউএসএআইডির কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছেন। অল্প কয়েক দিনেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মপরিধি দেখে আমেরিকার দীর্ঘদিনের মিত্র রাষ্ট্রও আজ আতঙ্কগ্রস্ত। কারণ ট্রাম্প তার সাময়িক স্বার্থের জন্য দীর্ঘদিনের মিত্রকেও দূরে ঠেলে দিতে পারেনÑইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এরই মধ্যে ট্রাম্প যা করে দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো বিশ্বের একক পরাশক্তি বনে যায়। যে ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকার অবৈধ সব যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদেরও ভুলতে বসেছে মার্কিন প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্য, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানসহ সব যুদ্ধে মার্কিনিদের অন্ধ সহযোগী হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো। আজ ট্রাম্প তার অর্থনৈতিক হিসাব মেলাতে ইউরোপকে পরিত্যাগ করতেও ভাবছে না। 

 



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে আমেরিকার ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হওয়া ইউরোপকে আজ তাই ভিন্ন পথ খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ ফিদেল কাস্ত্রো অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নাই।’ আমেরিকার বন্ধুত্বের কঠিনতম ফল দিয়ে যাচ্ছে আরব বিশ্ব। আমেরিকা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র বিক্রি করে বেড়ালেও, মধ্যপ্রাচ্যে এসে উটপাখির মতো স্বৈরতন্ত্রের পাহাড়ে চোখ ডুবিয়ে রাখে। আমেরিকার বন্ধুত্ব পাওয়ার বিনিময়ে সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, জর্ডান, আরব আমিরাত প্রভৃতি রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক সরকার ঠিকে থাকে, বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্ব থেকে অবৈধভাবে জ্বালানি তেল লুটপাট করে নিতে পারছে। একদিকে মার্কিন অস্ত্র আর বোমার আঘাতে ফিলিস্তিন মাটির সঙ্গে মিশে যায়, অন্যদিকে শান্তি চুক্তির আশায় আরব নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারে হন্যে হয়ে পড়ে থাকে।

 



দ্বিতীয়বার ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কপালে যে ভাঁজ দেখা গিয়েছিল, তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী বয়ে আনেন তা সময়ই বলে দেবে।