কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়া

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৫ মার্চ ২০২৫

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়া

নজিরবিহীন এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ডেকে নিয়ে এভাবে অপমান করার ঘটনা অতীতে আর ঘটেনি। একেই বলে জোর যার, মুল্লুক তার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেস সচিবের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন এবং মধ্যাহ্ন ভোজের কথা থাকলেও দুই নেতার বিতণ্ডার পর জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।

 

বিষয়টি পরবর্তীতে পরিষ্কার করেছেন ট্রাম্প নিজেই। জানিয়েছেন, ‘জেলেনস্কি যখন শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন আবার ফিরে আসতে পারেন।’ বিষয়টি এককথায় কূটনৈতিক এমনকি সাধারণ শিষ্টাচারবিবর্জিত হলেও এটি নিয়ে দুই নেতার পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই কথা বলছেন। নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক এর পক্ষে কথা বললেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রাম্পের পক্ষে কথা বলেছে একমাত্র রাশিয়া, সেটাও আবার কূটনৈতিক এবং রাষ্ট্রাচারের বাইরে গিয়ে জঘন্য বাজেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘রাশিয়া এটা দেখে অবাক হয়েছে যে ট্রাম্প এবং তাঁর ডেপুটি জেডি ভ্যান্স কিভাবে এই জঘন্য লোকটার গায়ে আঘাত না করে থাকলেন!’ মাত্র দেড় মাস সময়ের ব্যবধান! রাশিয়ার মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশংসাবাণী আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মুখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউক্রেনের লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলার জন্য জেলেনস্কিকে অভিযুক্ত করা! অথচ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ এবং অস্ত্রের জোরেই এই যুদ্ধের সূচনা, যার নিশ্চয়তা না থাকলে ইউক্রেনকে হয়তো বিকল্প পথে হাঁটতে হতো, হয়তো রাশিয়াকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হতো যে সে (ইউক্রেন) ন্যাটোতে যোগ দেবে না, পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের নামে এমন কিছু করবে না, যা রাশিয়ার স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।

 

ওভাল অফিস থেকে যখন জেলেনস্কি বের হয়ে যাচ্ছিলেন, দৃশ্যটা বলে দেয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। পুরো বিষয়টিই বলে দিচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন ট্রাম্প-ভ্যান্স। ইউরোপীয় দেশগুলো কোনো ধরনের রাখঢাক না করে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছে।

 

জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি চলে যান যুক্তরাজ্যে। কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে। তাত্ক্ষণিকভাবে ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পেয়েছেন সে দেশ থেকে। এই অর্থ দিয়ে নতুন করে অস্ত্র ক্রয় করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ইউক্রেন আর রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ দিয়ে ইউরোপের দায় মেটানো হবে। কতটুকু পারবেন জেলেনস্কি? শুধু ইউরোপের সহায়তায় রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে কত দিনই বা টিকে থাকতে পারবেন? এদিকে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে ইউরোপই বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে কিভাবে নেবে সেটাও একটা ভাবনার বিষয়।

 

পুরো পরিস্থিতি থেকে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে রাশিয়া। বাইডেন প্রশাসনের প্ররোচনায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেখানে রাশিয়ার হাত থেকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বাইরেও ইউরোপের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তার দিকটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তাও কি শঙ্কায় ফেললেন না ট্রাম্প?

 

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডায় লাভবান রাশিয়া

পরিস্থিতি থেকে এটাও বোঝা যায় যে জেলেনস্কির ওপর অনেকটা পুরনো ক্ষোভ ঝাড়ার সুযোগ পেয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৯ সালে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের একটি ফোনালাপ নিয়ে সে সময় ট্রাম্পের অভিশংসনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে বিরোধী পক্ষগুলো। এই ফোনালাপে জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে ব্যবসা পরিচালনায় দুর্নীতির বিষয় তদন্ত করার অনুরোধের বিনিময়ে ইউক্রেনকে বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা জেলেনস্কি মানেননি। ট্রাম্প চাচ্ছিলেন এর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর অবস্থানকে পোক্ত করবেন।

 

 

পরবর্তী সময়ে বাইডেনের কাছেই পরাজয় বরণ করে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয়। ওভাল অফিসে দুই নেতার কথোপকথনে উঠে আসে হান্টার বাইডেনের প্রসঙ্গও। এই বিষয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নিরাপত্তা বা জাতীয় স্বার্থ নয়, ট্রাম্পের কাছে তার ব্যক্তিস্বার্থই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আর একটি বিষয় রয়েছে, আর তা হলো একতরফাভাবে ইউক্রেনের খনিজ ভাগাভাগির বিনিময়ে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের একটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিয়েছেন। ধারণা করা যায়, এর পেছনে ইলন মাস্কের বড় ভূমিকা রয়েছে। মাস্কের স্পেসএক্সের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাফাইট জোগানের নিশ্চিত করতে ইউক্রেনকে টার্গেট করা হয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ছাড়াও মাস্ক মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। এবার সেটার প্রতিদান দেওয়ার পালা। আর এ জন্য বলি করার চেষ্টা করা হচ্ছে ইউক্রেনকে।

 

 

তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে যাচ্ছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন জেলেনস্কি। এত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সমন্বিত প্রক্সি যুদ্ধের ভয়ে রাশিয়ার তরফে একের পর এক ইউক্রেনের ভূমি দখল করা হলেও জেলেনস্কির জীবননাশের মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি রাশিয়া। পুতিনের ব্যক্তি চরিত্র বিশ্লেষণ করে যা জানা যায়, তিনি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে পছন্দ করেন না এবং সুযোগ পেলে তাদের বিনাশ করে দেন। এর উদাহরণ হিসেবে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোসিন এবং রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। রাশিয়া কি এবার এই সুযোগটি নেবে, নাকি অপেক্ষা করবে ট্রাম্প বাস্তবে ইউক্রেনের বিপক্ষে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তার ওপর? 

 

 

ট্রাম্প যেমনভাবে ভাবছেন সব কিছু সেভাবেই করতে পারবেন এবং আখেরে তিনি তাঁর দেশের জন্য সর্বোচ্চটা অর্জন করতে পারবেন, তেমনটা ভাবারও কারণ নেই। ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। লন্ডনে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে গত ২ মার্চ  এক সম্মেলনের আয়োজন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। যোগ দিয়েছে ইউরোপের কমপক্ষে এক ডজন দেশের সরকারপ্রধান ছাড়াও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ কানাডাও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত অভিন্ন চাপে রয়েছে। এই সম্মেলন থেকে ঘোষণা এসেছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা ইউক্রেনের পাশে থাকবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় ইউক্রেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে।

 

 

এ যেন যুক্তরাষ্ট্রকে একধরনের চপেটাঘাত! এ ছাড়া রাশিয়ার দিক থেকে অভিন্ন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় তারা নতুন জোট প্রতিষ্ঠার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছে। এত দিন ধরে ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প অনেক বেফাঁস কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত—এমন কথা বলতেও ছাড়েননি তিনি। ইউরোপের দেশগুলো ট্রাম্পের এ ধরনের সম্ভাব্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে সচেতন রয়েছে। তারা সম্ভবত এটা এখন উপলব্ধি করছে যে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তারা বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, সঙ্গে পাচ্ছে কানাডাকেও। এ ক্ষেত্রে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটুকু সফল হতে পারবেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেই, রাশিয়া এই স্পষ্ট বার্তা পেয়েছে। এদিক দিয়ে তারা নতুন করে লাভবান হতেই পারে।

 

 

ইউক্রেনের ওপর তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার উসকানির জন্য দোষারোপ করেছেন। ইউক্রেনের আত্মরক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি তবে কোথায় থাকল! তা ছাড়া ইউক্রেনকে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার জন্য বাইডেনকে তিনি ‘স্টুপিড’ প্রেসিডেন্ট বলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দায় ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে মনোভাব দেখিয়েছেন, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।  নিজ ঘরে অতিথিকে ডেকে নিয়ে এমন অপমান, এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রাচারের সঙ্গে যায় না। তবে জেলেনস্কির সাহসের প্রশংসা করতে হয়। রীতিমতো ট্রাম্প-ভ্যান্সের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। একসময় ইউক্রেনকে নিয়ে খেলেছেন বাইডেন, এখন খেলতে চাচ্ছেন ট্রাম্প।

 

 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের  ঝুঁকি তিনিই অনেক বাড়িয়ে তুলেছেন। ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একতরফাভাবে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা করার মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপের সমন্বিত উদ্বেগকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছেন। লন্ডন সম্মেলন ট্রাম্পের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্ত তারা মানছে না। সিদ্ধান্ত এটাই যে ইউক্রেন তার আত্মরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবে, পাশে থাকবে ইউরোপ। বিষয়টি কঠিন, যা স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং ইউরোপের কিছু নেতাও। যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া এই লড়াইয়ে শুধু ইউরোপের সহায়তা, সেটা যতটা বর্ধিতই হোক না কেন ইউক্রেনের পক্ষে রশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়, তার মানে লাভবান হচ্ছে রাশিয়াই, মাঝে ইউরোপের সঙ্গে যে দূরত্ব ট্রাম্প সৃষ্টি করলেন, এটা মেরামতের সুযোগ তিনি কতটা পাবেন সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।   

 

 লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়