ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকে যেভাবে চাঁদাবাজি হলো
লেখা : এম গেসেন [প্রকাশ : প্রথম আলো, ২০ আগস্ট ২০২৫]

যাঁরা দিনের খবর কিছুটা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন আর কিছু ইউরোপীয় দেশের নেতারা গত সোমবার হোয়াইট হাউসে বসেছিলেন। আলোচ্য বিষয় ছিল একটি ভূমি বিনিময় ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। এটি নাকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ওটা আলোচনা ছিল?
মানুষ বলে, সব যুদ্ধ শেষ হয় আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণত আক্রমণকারী রাষ্ট্র এমন জমি দাবি করে না যেটা তার দখলে নেই। যুদ্ধের সময় যা দখল হয়েছে, সেটা রাখা হবে নাকি ফেরত দেওয়া হবে, সাধারণত সেটিই আলোচনায় থাকে। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন সব সময় এমন ভূখণ্ড দাবি করেছেন, যেটা তাঁর সেনারা সাড়ে তিন বছর ধরে যুদ্ধ করেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। গত শুক্রবার আলাস্কায় ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে পুতিন সামান্য ছাড় দিয়েছেন বটে; তবে এখনো তিনি দখল করা ভূমির চেয়ে বেশি ভূমি চাইছেন। অবশ্য আগে যা চেয়েছিলেন, তার চেয়ে এবার একটু কম চাইছেন। কিন্তু কম হলেও সেটা এখনো অতিরিক্ত দাবিই থেকে যাচ্ছে।
ভূমি বিনিময় কথাটা শোনাতে যা বোঝায়, পুতিনের প্রস্তাবটি সে ধরনের কিছু নয়। আদতে তিনি ইউক্রেনের একটি অংশ নিতে চান। এর বিনিময়ে তিনি ইউক্রেনের আরও বড় অংশ দখল করার হুমকি থেকে বিরত থাকবেন। এটাকে বিনিময় বলা যায় না। এটাকে বলে চাঁদাবাজি।
আলোচনায় নেতারা বারবার ‘ভূমি’ বা ‘এলাকা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প নাকি জেলেনস্কিকে একটা মানচিত্র দিয়েছিলেন আলোচনা সহজ করার জন্য; আর জেলেনস্কিকে একটি কপি দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ভূমি মানে মানচিত্রের দাগ নয়। ওই জমিতে মানুষ থাকে। সেখানকার শহর, গ্রাম, বাজারে এখনো জীবন চলছে। এমনকি যুদ্ধের সম্মুখভাগেও মানুষ তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে।
পুতিন যেসব এলাকা চাচ্ছেন, তার মধ্যে ক্রামাতোরস্ক আর স্লোভিয়ানস্ক—এই দুই ইউক্রেনীয় শহর আছে। যুদ্ধ শুরুর আগে সেখানে জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে দুই লাখ ও এক লাখ। এখন কত মানুষ আছে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। কেউ পালিয়েছে, কেউ দখল হওয়া এলাকা থেকে সেখানে এসেছে, কেউ প্রাণ হারিয়েছে। তবে এখনো হয়তো সেখানে লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে।
যদি ইউক্রেনের জমি রাশিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাহলে এর মানে দাঁড়ায়, সেখানে বসবাসকারী মানুষদের হয় রাশিয়ার দখলদারি মেনে নিতে হবে, নয়তো জোর করে তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হবে। দুটোই অপরাধ। আর এই অপরাধে ট্রাম্প আসলে জেলেনস্কিকে অংশীদার করতে চাইছেন।
এমন চাঁদাবাজি দিয়ে আলোচনার উদাহরণ নতুন নয়। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতারা মিলেছিলেন ইয়াল্টা সম্মেলনে। সম্মেলনস্থল ছিল তখনকার সোভিয়েত ইউক্রেনের শহর আর এখনকার রাশিয়া-অধিকৃত ক্রিমিয়া। সেখানেই জোসেফ স্তালিন চেয়েছিলেন কুরিল দ্বীপপুঞ্জ। দীপপুঞ্জটি সোভিয়েত কামচাটকা থেকে জাপানের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। রুজভেল্ট আর চার্চিল সোভিয়েতকে কুরিল দ্বীপগুলো দিতে রাজি হয়েছিলেন, যদিও দ্বীপগুলো তাদের নিজের ছিল না, সেগুলো ছিল জাপানের। তবে সোভিয়েত চাইলে জোর করে নিতে পারত। আর তা–ই হলো। ছয় মাস পর সোভিয়েত সেনারা দ্বীপ দখল করল এবং জাপানি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করল।
এই অভিযান শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, ঠিক ৮০ বছর আগে, যেদিন ট্রাম্প আর জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে মিলিত হন। ইতিহাসপ্রেমী পুতিন বহুদিন ধরে দ্বিতীয় ইয়াল্টা সম্মেলনের ধারণা ছড়াচ্ছেন।
সোমবার সকালে রাশিয়ার সরকারি পত্রিকা রসিস্কায়া গেজেতা একটি ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এক সাঁজোয়া যান একসঙ্গে মার্কিন ও রাশিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছে। পত্রিকাটিতে দাবি করা হয়, ইউক্রেনীয় সেনাদের হাত থেকে দখল করা এই যান রাশিয়া এখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ভিডিওটি আসল কি না জানা নেই, কিন্তু এর মাধ্যমে রাশিয়া স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গী।
জাপান এখনো রাশিয়ার সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেনি। কারণ, কুরিল দ্বীপ তারা ছাড়েনি। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়নি এই দুই দেশের মধ্যে। তাই বলা যায়, সব যুদ্ধ আলোচনায় শেষ হলেও, সব আলোচনা শান্তি আনে না।
১৯৩৮ সালে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেনল্যান্ড দাবি করেন, যেখানে অনেক জার্মান বংশোদ্ভূত মানুষ বাস করতেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়াই সেই জমি হিটলারকে দিয়ে দেন। লক্ষ্য ছিল ইউরোপে শান্তি আনা। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন, আর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার দাবি করেছিলেন যে তিনিও শান্তির জন্য যুদ্ধ করছেন। তাই বাধ্য হয়েই সুদেতেনল্যান্ড দখল করছেন। ২০১৪ সালে যখন পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেন, তখনো তিনি প্রায় একই যুক্তি দেন, ‘আমরা শান্তি চাই, তাই আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’
এবার আসি নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রসঙ্গে। আগে হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি যখন এ বিষয় তুলেছিলেন, তাঁকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। এবার ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো শান্তিচুক্তি সম্ভব নয়। তিনি দাবি করেছেন, পুতিনও এটা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী ধরনের নিশ্চয়তা? পুতিন বারবার বলেছেন, ইউক্রেন আসলে কোনো দেশ নয়, তাদের আলাদা জাতি বা ভাষা নেই। তাহলে ইউক্রেনকে কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব, যখন পাশেই এমন এক পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র আছে যে বিশ্বাসই করে না ইউক্রেনের অস্তিত্বে?
সবচেয়ে কার্যকর নিশ্চয়তা হতে পারে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ। কিন্তু পুতিন বহুবার বলেছেন, ন্যাটোতে ইউক্রেন যোগ দেবে, এই আশঙ্কাই যুদ্ধ শুরু করার মূল কারণ। তাই ইউক্রেনকে বাস্তব নিরাপত্তা দেওয়া হবে, এমন কোনো চুক্তি পুতিন মেনে নেবেন, সে সম্ভাবনা নেই।
সোমবার ট্রাম্প বারবার বলছিলেন, তিনি নাকি প্রথম সাত মাসে ছয়টি যুদ্ধ থামিয়েছেন। ট্রাম্পের দাবিমতে, এগুলো হলো কঙ্গো বনাম রুয়ান্ডা, মিসর বনাম ইথিওপিয়া, ভারত বনাম পাকিস্তান, কসোভো বনাম সার্বিয়া, আর্মেনিয়া বনাম আজারবাইজান, কম্বোডিয়া বনাম থাইল্যান্ড, ইসরায়েল বনাম ইরান। তিনি দাবি করেছেন যে বাংকার ধ্বংসকারী বোমা ফেলে তিনি একটি পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছেন।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব সংঘাতের কোনোটাই পুরোপুরি থামেনি, কোনোটা কেবল অস্ত্রবিরতিতে গেছে। মানে ট্রাম্পের কথিত ছয়টি সমাধানের মধ্যে আসলে একটিরও প্রকৃত সমাধান হয়নি।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
এম গেসেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট।