ট্রাম্প-মোদি বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কী চমক আনবে
ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২০২৫

এশিয়া অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সহযোগী রাষ্ট্র ভারত। নব্বইয়ের দশক থেকে চলতে থাকা ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সম্পর্ক সময়ের বিবর্তনে বর্তমানে অন্য রকম উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান চলমান এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল সাবেক ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ে। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক এবং ভারতের কংগ্রেস ও বিজেপি সরকারগুলো এই সম্পর্ককে ধরে রেখেছে এবং দুই দেশের মধ্যকার এই কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে।
২০১৭-২১ মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে তাঁর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ সখ্য গড়ে ওঠে। ক্ষমতায় থাকাকালে এবং ক্ষমতার বাইরে গিয়েও তিনি বিভিন্ন সময়ে নরেন্দ্র মোদিকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলাকালে তিনি ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। গত ২০ জানুয়ারি তাঁর শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে যে কজন রাষ্ট্রনেতাকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এর মধ্যে নরেন্দ্র মোদিও ছিলেন।
সে সময় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এস জয়শঙ্কর উপস্থিত হয়েছিলেন। শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে ২৭ জানুয়ারি দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে ভবিষ্যতে একত্রে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব বিবেচনায় ভারত যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, এর অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি হতে যাচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহুর পর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি, যিনি আগামী ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উষ্ণতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে বলে যে ধারণা করা হয়েছিল, সে জায়গায় নতুন করে কিছুটা সন্দেহেরও সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি যে অভিবাসননীতিতে স্বাক্ষর করেছেন, তার আওতায় এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যায় অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত ভারতীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ১০৪ জন অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এই সমালোচনাকে পাশ কাটাতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিজস্ব অভিবাসননীতি সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে, যার আওতায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা আরো বেশি সংখ্যায় ভারতীয়দের দক্ষ হিসেবে তৈরি করে বৈধ পন্থায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে প্রেরণের কথা বলছে।
এটি একটি দিক, অপর বিষয়টি হচ্ছে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি, যার আওতায় এরই মধ্যে চীন, মেক্সিকো ও কানাডার পণ্য আমদানির ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি তিনি মেক্সিকো ও কানাডার বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এটি এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে, এই বাড়তি শুল্ক ব্যবস্থা কার্যকর হলে দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। কারণ মেক্সিকো ও কানাডাও প্রতি উত্তরে জানিয়েছে যে এমন হলে তারাও তাদের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানীকৃত পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।
এর মধ্যে নতুন করে এই শুল্ক নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে ভারত সরকারের ভেতর। ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর শুল্ক আরোপ নীতি ভারত থেকে পণ্য আমদানির ওপরও আরোপিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগের মেয়াদেও যখন তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ভারত সরকারের শুল্কনীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন, যার কারণে সে সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি করা কিছু পণ্যের ওপর শুল্কহার হ্রাস করে ভারত সরকার।
এবার এরই মধ্যে দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে মোদি সরকারের প্রতি আরো বেশি হারে প্রতিরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের হিসাবে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং এই অর্থের মধ্যে ভারতের রপ্তানি আয়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ৩২ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতিতে ছিল। এবার ট্রাম্প চাচ্ছেন এই ঘাটতির পরিমাণ আরো কমিয়ে আনতে এবং ভারতের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে আরো অধিক হারে এবং শুল্কমুক্ত পন্থায় প্রবেশ করাতে।
ট্রাম্প কি এ বিষয়ে ভারতকে একটি জুতসই বিকল্প হিসেবে পেতে চাইছেন কি না, সেটিও ভাবনার দাবি রাখে। মেক্সিকো ও কানাডার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির পর তাদের দিক থেকে পাল্টা শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণার পর সেখান থেকে এক মাসের জন্য সরে আসার কারণ হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন জনগণের ওপর বাড়তি করের বোঝা সৃষ্টি হবে এবং জন-অসন্তোষ বাড়তে পারে।
সরকারের এই শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন আমদানিকারকদের পণ্য আমদানির ওপর সরকার ঘোষিত এই বাড়তি কর পরিশোধ করে তা অধিক মূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যার মূল শিকার হবে ভোক্তারা, যদিও তিনি চীনের ওপর থেকে এই বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সমতা আনয়নের মাধ্যমে মার্কিন ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি দেওয়ায় মনোযোগী হতে পারেন। আর এ জন্যই তিনি মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ হতে পারে এমন আতঙ্কে কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার আওতায় তারা কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্কহার অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে, এমনকি কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক একেবারে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো মার্কিন ডলারের আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করার যে নীতি নিয়েছিল, সেখান থেকে সরে আসতে সম্মতি দিয়েছে ভারত।
এ ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি আশঙ্কার বিষয় যে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের পণ্য রপ্তানির জন্য সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী চীনের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে তাদের মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা যায়, মোদির সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে চান ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে তাঁর দিক থেকে এমন চাওয়া থাকতে পারে, যেন ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন কোনো অগ্রগতি না হয় এবং এর বিপরীতে কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মধ্যকার সহযোগিতা ফোরাম) এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) মতো সহযোগিতা ফোরামগুলোকে আরো শক্তিশালী করে সেখানে ভারতের জন্য নতুন করে অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে পারে। পাশাপাশি ফেরত পাঠানো ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীদের স্থলে দক্ষ ভারতীয়দের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় আপাতত চীনের প্রতি কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা লক্ষণীয় হচ্ছে না। বিষয়টি অনুধাবন করে চীনের পক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পোশাক, কয়লা ও তরল জ্বালানির ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি এবং অপরিশোধিত তেল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধাতু রপ্তানিতেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা ভাবছে চীন সরকার। এসব থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে এই অঞ্চলে ভারতের সহযোগিতা একান্তভাবে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। কারণ ভারত যদি বিক্ষুব্ধ হয়, তাহলে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের আরো উন্নয়ন ঘটতে পারে, যা বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে একদম বদলে দেবে। তা ছাড়া এত দিন ধরে গড়ে ওঠা কোয়াড এবং আইপিএসের মতো ফোরামগুলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই তাদের বিনিয়োগ করে আসছে, একেবারেই অকার্যকর হয়ে যাবে এবং এই অঞ্চলে চীনের উত্থান ঠেকাতে আর কোনো কার্যকর পথই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবশিষ্ট থাকবে না। সে বিবেচনায় ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
দুই নেতার মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয় আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে। এ ক্ষেত্রে ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিষয়ে কী ধরনের চাওয়া থাকবে, তা স্পষ্ট নয়। ধারণা করা যায় যে ভারতের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভারতের সবচেয়ে বড় সহযোগী হতে পারে বাংলাদেশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন চলছে, যা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে কি না এবং সেটি কোন উপায়ে সম্ভব—সেসব নিয়েই আলোচনা হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়