ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ
ডগলাস মারে [সূত্র : কালবেলা, ১৭ আগস্ট ২০২৫]

রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে রুশ সৈন্যদের অবৈধ প্রবেশের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। রাশিয়া যখন (২০১৪ সালে) ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়, ইউক্রেনবাসীর কাছে তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রতিবেশী হিসেবে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে ভ্লাদিমির পুতিন মোটেই আগ্রহী নন। আক্রমণের (২০২২) পর ইউক্রেনের পূর্বের বৃহৎ একটি অঞ্চল, ক্রিমিয়ার প্রায় সাতগুণ পরিমাণ জায়গা দখল করে নেয় রাশিয়া। যদিও তার উত্তর-পশ্চিমের অর্ধেকটা ধাপে ধাপে পুনরুদ্ধার করে ফেলেছে ইউক্রেনের যোদ্ধারা; কিন্তু বাকি অর্ধেক অঞ্চল মরণকামড় দিয়ে ধরে রেখেছে রাশিয়া। দেড় লক্ষাধিক রুশ সৈন্য প্রাণ হারানোর পরও এ অঞ্চল ছাড়ার কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না রাশিয়ার সরকার।
এ ব্যাপারে ১৫ আগস্ট শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা রাজ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপে অংশ নেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার স্থলসীমানা না থাকলেও বেরিং সাগরে দুদেশের জলসীমানা রয়েছে। আলাস্কার বৃহত্তম শহর অ্যাঙ্করেজের বিমানবন্দরে লালগালিচায় দাঁড়িয়ে ট্রাম্পকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পুতিন বলেন, ‘শুভ অপরাহ্ণ, প্রিয় প্রতিবেশী। আপনাকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় দেখে খুব ভালো লাগছে।’ আলোচনার পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নিজ বক্তব্যের প্রসঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করে বলেন, ‘আমার ধারণা আমি এ মুহূর্তে যথেষ্ট প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করছি।’
অথচ এই আলাস্কা সম্মেলনের উদ্দেশ্যই ছিল প্রতিবেশীর প্রতি পুতিনের বৈরী আচরণের লাগাম টেনে ধরা। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে রুশ ও মার্কিন নেতাদের মুখোমুখি কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান একটা কারণ হলো, ভ্লাদিমির পুতিন তার শুরু করা যুদ্ধ থামাতে একেবারেই অনিচ্ছুক। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কটা সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার নয়। এই দুই দেশের মধ্যে সামঞ্জস্য খুবই কম। যুদ্ধে বেসামরিক ব্যক্তিদের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না পশ্চিমা শক্তিগুলো। পুতিনের শুরু করা যুদ্ধে যে কেবল দেড় লাখ রাশিয়ান সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে, কেবল তাই নয়; একই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৪০০ সাধারণ রাশিয়ান নাগরিক। অন্যদিকে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনীয়দের পক্ষে যে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তার মধ্যে ১৫ হাজারই ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিক।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই ট্রাম্প ঢালাওভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন যে, তিনি যদি ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকতেন, তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুই হতো না। সম্মেলনে পুতিন কৌশলে এ ব্যাপারে সম্মতি ব্যক্ত করেন। দুপক্ষের মধ্যে একটি সংগতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন তার দেওয়া সতর্কবার্তাগুলোর কোনো সাড়া দেয়নি বলে আফসোস করেন তিনি। তবে ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন যে, পুতিনের এই প্রশংসাসূচক বুলিগুলো একটা চতুর ফাঁদের অংশ। পুরো সংবাদ সম্মেলনজুড়ে পুতিন যখন দীর্ঘ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, ট্রাম্প তখন তার স্বভাবসিদ্ধ, চিন্তাশীল মনোযোগী ভঙ্গি ধরে রেখেছেন। কারণ তিনি জানেন যে, পুতিনের মতো ধূর্ত নেতার সঙ্গে আলোচনার আসরে ভুল সময়ে একটা হাসিও পরবর্তী সময়ে প্রাণঘাতী বলে প্রমাণিত হতে পারে।
এ ছাড়া শুধু পুতিনের জন্য নয়, বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্যও ট্রাম্পকে থাকতে হয়েছে সজাগ। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ট্রাম্পকে ‘পুতিনের পুতুল’ বলে বিদ্রুপ করা হয়েছে অসংখ্যবার। এ সচেতনতা থেকেই ট্রাম্প বৈঠকটি সাজান নিজের শর্ত অনুযায়ী। বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রভাব খাটানোর কৌশলের জন্য বেশ কুখ্যাত রাশিয়ার এই প্রেসিডেন্ট। তিনি প্রতিপক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলে নিজেকে বড় করে দেখাতে পছন্দ করেন। এজন্য ট্রাম্প আলাস্কায় যখন প্রথম পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন বেশ সাবধানে করমর্দন করেন তার সঙ্গে। ট্রাম্পের শারীরিক ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে কিছুটা উষ্ণতা, কিছুটা শৈথিল্য।
চুক্তি করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু পুতিন চুক্তিতে আসবেন কি না, সেটাই ছিল দেখার বিষয়। বিমানবন্দর থেকে তারা যখন হেঁটে বের হচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় একটি মার্কিন বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান। ট্রাম্প থেমে যান এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে পাইলটের প্রতি স্বীকৃতি জানান। তিনি যেন কৌশলে পুতিনকে বলতে চান, ‘দেখে রাখো, এই মার্কিন বিমানই ইরানের পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মনে আছে তো?’
এরপর আড়াই ঘণ্টাব্যাপী তারা বন্ধ কক্ষে বৈঠক চালিয়ে যান। আলোচনা শেষে দুজন একসঙ্গে বেরিয়ে আসেন। কক্ষ থেকে একত্রে প্রস্থানটা একটি ইতিবাচক সংকেত ছিল। ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন, যদি বৈঠকের পর তারা একসঙ্গে না বের হন, তবে বুঝতে হবে যে আলোচনা সম্পূর্ণ বিফল হয়েছে। ২০১৯ সালের হ্যানয় বৈঠকে এমনটা ঘটেছিল। আলোচনাকে কেন্দ্র করে অনেক উচ্চ প্রত্যাশার পর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় আসতে না পেরে ট্রাম্প সোজা হেঁটে বেরিয়ে যান। এবার তেমনটা ঘটেনি। যারা বিশ্বাস করেন যেম কূটনৈতিক কথোপকথন যুদ্ধের চেয়ে ভালো, তাদের জন্য এটাই একটি ইতিবাচক সংকেত।
আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের আচরণ ছিলেন একই সঙ্গে বন্ধুসুলভ ও আনুষ্ঠানিক। তিনি স্বীকার করে নেন যে, আলোচনা গঠনমূলক হলেও দুপক্ষের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি। কারণ এখনো কিছু ছোট বিষয় এবং একটি ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ে মতৈক্য হয়নি। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, সেই ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়টি হলো—এরই মধ্যে দখল করে নেওয়া ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড পুতিন ইউক্রেনকে ফেরত দেবেন কি না, সেটা। এটি কেবল ইউক্রেনীয় জনগণের নয়, ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রদেরও একটি বড় প্রশ্ন। লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ প্রায় সমগ্র ইউরোপের আশঙ্কা হলো, ইউক্রেনের দখল হয়ে যাওয়া অংশ রাশিয়াকে ফেরত দিতে বাধ্য না করা হলে পুতিনের লোভ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। তাদের জন্য এটা কেবল আঞ্চলিক কৌশলগত বিষয় নয়; বরং এখানে তাদের নিজেদের অস্তিত্বের ঝুঁকি রয়েছে। কোনো ধরনের বাধা দেওয়া না হলে পুতিন যে কোনো সময় তাদের দেশেও আক্রমণ চালাতে পারেন।
আলাস্কায় ট্রাম্পকে তাই সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়েছে। তিনি পুতিনকে অন্তত আলোচনায় বসাতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি পুতিন এটাও বলেছেন যে, তিনি যুদ্ধ শেষ করতে ‘আন্তরিকভাবে আগ্রহী’। যুদ্ধটাকে তিনি একটি বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এটা ঘূর্ণিঝড় বা সুনামির মতো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; বরং তার নিজের সৃষ্ট বিপর্যয়। কোনো চুক্তিতে তাকে আবদ্ধ করা না গেলেও ট্রাম্প বলেন, ‘অন্তত যুদ্ধ নিরসনের প্রথম পদক্ষেপটা আমরা গ্রহণ করেছি, আমরা গঠনমূলক আলোচনা শুরু করেছি।’ সংবাদ সম্মেলন শেষে ট্রাম্প পুতিনকে ডাক নাম ধরে সম্বোধন করেন এবং পুতিন পরবর্তী বৈঠকটা মস্কোতে আয়োজন করার প্রস্তাব দেন। জবাবে ট্রাম্প হাস্যরসের ভঙ্গিতে বলেন, ‘সেটা অসম্ভব কিছু নয়। দেখা যাক।’
যদি পরবর্তী বৈঠক যুদ্ধের অবসান ঘটানোর পথ সুগম করে দেয়, তবে নিঃসন্দেহে সেটি ভালো বিষয়; বৈঠক যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন। কিন্তু ট্রাম্পকে মনে রাখতে হবে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে কত মিল, তাদের শিকড় কত গভীর, তাদের সম্পর্ক কত দৃঢ়—এ ব্যাপারগুলোর ওপর পুতিন বারবার আলোকপাত করেছেন। এর থেকে স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের ওপর থেকে তার দখল ছাড়ানোটা মোটেই কোনো সহজ কাজ হবে না। একদিকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ভান করে; অন্যদিকে সামরিক বল প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দক্ষতা যদি কোনো বিশ্বনেতার থেকে থাকে, তবে তিনি হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
লেখক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, লেখক, রাজনৈতিক সমালোচক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। নিবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’-এর মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ