ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতির কথা শুনলে মনে পড়ে যায় ১৯৩০ সালের সেই ভয়ংকর সময়ের কথা, যখন যুক্তরাষ্ট্র স্মুট-হলি ট্যারিফ চালু করে পুরো বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ওই সময় আমেরিকা প্রায় সব বিদেশী পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক বসায়, জবাবে ইউরোপ-এশিয়ার দেশগুলো একই কাজ করে। ফলটা কী হয়েছিল? বিশ্ব বাণিজ্য প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে, কাজ হারায় লাখো মানুষ, আর অর্থনৈতিক মন্দা হয়ে উঠেছিল মহামারীর মতো! আজ ট্রাম্প যেন সেই একই পথে হাঁটছেন—মেক্সিকো, কানাডা, চীনের ওপর ট্যারিফ দিয়ে নিজেরই অর্থনীতিতে আঘাত করছেন। যেমন গত সপ্তাহে ঘোষিত চীনের ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর ১০০% ট্যারিফ! এতে আমেরিকান ভোক্তাদের জিনিসপত্রের দাম তো বাড়বেই, সঙ্গে বিশ্ববাজারে নেমে আসছে অস্থিরতার ছায়া!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ডলারকে বিশ্বের ‘মূল মুদ্রা’ বানিয়ে এক ধরনের ‘সুপারপাওয়ার’ স্ট্যাটাস পেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের যুগে এ ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। যেমন গত মাসে ট্যারিফ ঘোষণা করতেই ডলারের দাম হুড়মুড় করে নিচে নামল—যেটা আগে কখনো হয়নি! অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা বিশ্বাস ভাঙার সংকেত। ঠিক যেমন ১৯৭১ সালে নিক্সন ডলারকে স্বর্ণের বিনিময়যোগ্যতা বাতিল করেছিলেন, তখনো বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছিল ডলার নিয়ে সংশয়।
ইতিহাস বলে, বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ জেতে না—সবাই হারেই। যেমন ১৯৮০-তে আমেরিকা জাপানি গাড়ির ওপর ট্যারিফ দিয়েছিল, কিন্তু আমেরিকান কারখানাগুলো তখনো প্রতিযোগিতা করতে পারেনি। বরং জাপানিরা আমেরিকায় কারখানা খুলে সস্তায় গাড়ি বানিয়ে দিব্যি কাটিয়ে নিয়েছে! ঠিক তেমনি, এখন চীনের ওপর ট্যারিফ দিলে চীনারা মেক্সিকো বা ভিয়েতনামে কারখানা সরিয়ে নেবে, আর নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো নিরপেক্ষ দেশগুলো চীন-আমেরিকা দুই পক্ষের কাছেই পণ্য বিক্রি করে লাভবান হতে পারবে। কিন্তু এ ‘সুবিধা’ সাময়িক! কারণ বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘ হলে পুরো বিশ্বের ক্রয়ক্ষমতা কমবে, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার রফতানিও পড়তির দিকে যাবে।
শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সবচেয়ে সফল দেশ সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে ৯৯ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত। গড় শুল্কহার মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ (বিশ্বব্যাংক ডাটা, ২০২৩)। বর্তমানে দেশটি ২৭টি অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইইউ, ভারত, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও রয়েছে। দেশটির জিডিপির ৩২৬ শতাংশ আসে বাণিজ্য থেকে (বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)! রফতানি-আমদানির পরিমাণ প্রায় ৮০০ বিলিয়ন (২০২৩), যা দেশটির জনসংখ্যার (৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন) তুলনায় অবিশ্বাস্য। বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দর সিঙ্গাপুরের, সমুদ্রপথে বিশ্বের ২০ শতাংশ কনটেইনার শিপমেন্ট এখানে পরিচালিত হয়। দেশটি ডিইপিএর (ডিজিটাল ইকোনমি পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) উদ্যোক্তা, যা ডাটা ফ্লো, ই-কমার্স ও ডিজিটাল পেমেন্টের নিয়ম বিশ্বে প্রথমবারের মতো স্থাপন করেছে। এটি এশিয়ার ফিনটেক হাব পেপাল, আলিবাবা, গ্র্যাবের মতো কোম্পানিগুলোর আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্টে বাণিজ্য উদারীকরণে প্রথম (২০২৩)। এমনকি হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ইকোনমিক ফ্রিডম ইনডেক্সে টানা ২৫ বছর ধরে শীর্ষ ৩-এ দেশটি।
ইতিহাসের পাঠ মনে রেখে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার উচিত আমেরিকার উল্টোপথে হাঁটা। এখনই সময় ১৯৭৩ সালের গফ হুইটলামের মতো সাহস দেখানোর! তিনি তখন সব ট্যারিফ ২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে অস্ট্রেলিয়ান পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিল। আজও যদি বাকি ছোটখাটো ট্যারিফ (যেমন পোশাক, ফার্নিচারে ৫ শতাংশ)ও বাদ দেয়া হয়, তাহলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অস্ট্রেলিয়াকে ‘নির্ভরযোগ্য’ বাজার হিসেবে দেখবে। আঞ্চলিক জোটে জোর দেয়াও দরকার দেশগুলোর। CPTPP (যে চুক্তি থেকে ট্রাম্প ২০১৭ সালে বেরিয়ে গিয়েছিলেন!) বা RCEP-এর মাধ্যমে এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো এখন দ্রুত বর্ধনশীল। তাদের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বাড়ালে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার কৃষি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি সেক্টর লাভবান হবে।
অস্ট্রেলিয়ার পথ অনুসরণ করে মুক্ত বাণিজ্যের নীতি গ্রহণ করতে পারে অন্যান্য দেশও। অস্ট্রেলিয়ার মতো নিউজিল্যান্ডও CPTPP-এর সদস্য এবং কৃষি রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের জন্য লবিং করছে। তাদের ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত পণ্য! তারা চীনের সঙ্গে FTA (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) জোরদার করে ডেইরি পণ্য রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। গত বছর চীনে নিউজিল্যান্ডের দুধ রফতানি বেড়েছিল ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালে তারা ডিজিটাল ইকোনমি পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্টে (ডিইপিএ) যোগ দিয়ে সিঙ্গাপুর ও চিলির সঙ্গে ডিজিটাল ট্রেডের নিয়ম তৈরি করেছিল।
কানাডার USMCA (যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি) থাকলেও ইউরোপের সঙ্গে CETA (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি করে ৯৮ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করেছে। কানাডার উচিত এশিয়ার দিকে মনোযোগ দেয়া। ইন্দো-প্যাসিফিকে CPTPP-এর মাধ্যমে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো। CETA-এর ফলে ইউরোপে কানাডার কৃষিপণ্য রফতানি ১৫ শতাংশ বেড়েছে। লাতিন আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি FTA-সমৃদ্ধ দেশ (৬০+ দেশের সঙ্গে চুক্তি) হলো চিলি। চীনের সঙ্গে তাদের FTA-এর ফলে ওয়াইন ও ফল রফতানি বেড়েছে ২০০ শতাংশ! চিলিরও উচিত এশিয়া-প্যাসিফিকের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানো। CPTPP-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে খনিজ সম্পদ রফতানির সুযোগ কাজে লাগানো। ১৯৭০-৮০-এর দশকে চিলি মুক্তবাজার নীতি গ্রহণ করে লাতিন আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন ও ইউরোপের সঙ্গে FTA করে অটোমোবাইল ও সেমিকন্ডাক্টর রফতানি বাড়িয়েছে। বর্তমানে ভারত, ASEAN-এর সঙ্গেও চুক্তি করছে।
দেশটির CPTPP-এ যোগ দেয়া ইতিবাচক হবে। এরই মধ্যে ২০২২ সালে আবেদন করেছে, যা তাদের চীন-জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য সুবিধা দেবে। ২০০০ সালের পর দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি আয় পাঁচ গুণ বেড়েছে, FTA-এর ফলে।
ইউরোপের গেটওয়ে হিসেবে নেদারল্যান্ডস কৃষি ও হাই-টেক পণ্য রফতানি করছে। তাদের বন্দর (রটারডাম) বিশ্বের ব্যস্ততম! তারা ইউরোপের বাইরে এশিয়া-আফ্রিকার সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করতে পারে। যেমন ভারতের সঙ্গে FTA আলোচনা ত্বরান্বিত করা। দেশটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব। ইইউয়ের ৪০ শতাংশ পণ্য নেদারল্যান্ডসের মাধ্যমে বণ্টন হয়! মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা ভোগ করছে এশিয়ার আরেকটি দেশ ভিয়েতনাম। CPTPP, RCEP-এ যোগ দিয়ে দেশটি টেক্সটাইল ও ইলেকট্রনিকস রফতানি বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে তাদের রফতানি আয় ৩৭১ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৯০ শতাংশ! দেশটি পরিবেশবান্ধব শিল্পে বিনিয়োগ করে ইউরোপে টেকসই পণ্যের বাজার দখলের চেষ্টা করতে পারে। মার্কিন-চীন ট্রেড যুদ্ধের লাভভোগী হিসেবে চীনের বিকল্প হিসেবে বিদেশী কোম্পানিগুলো ভিয়েতনামে কারখানা স্থানান্তর করছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের আগুনে পোড়া ইতিহাসের গল্প আমাদের শেখায়—দেয়াল তোলা নয়, সেতু বানানোই সমৃদ্ধির পথ। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চিলির মতো মধ্যম শক্তির দেশগুলোর জন্য এটা সুযোগ: আমেরিকা-চীনের কোন্দলের ফাঁকে নিজেকে ‘শান্তির দূত’ বানানো, আর বিশ্বকে দেখানো যে মুক্তবাজার ও সহযোগিতা ছাড়া উন্নতি অসম্ভব। যেভাবে ১৯৪৫-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপ থেকে বিশ্ব GATT (পরবর্তী সময়ে WTO) বানিয়ে উঠেছিল, আজও সেই একই সংকল্প দরকার! ১৯৩০-এর দশকের সুরক্ষাবাদের বিপরীতে, ১৯৯০-পরবর্তী বিশ্বায়ন যুগে মুক্তবাণিজ্য বিশ্বজুড়ে ১০০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে এনেছে। আজকের চ্যালেঞ্জ হলো আমেরিকা-চীনের টানাপড়েনের মধ্যেও সেই পথ ধরে রাখা।
ড. মিরাজ আহমেদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস