কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ, মন্দার আশঙ্কা

ড. মো: মিজানুর রহমান। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৪ মার্চ ২০২৫

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ, মন্দার আশঙ্কা

এবারের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব কতটা ব্যাপক হয় এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা কতটা বেড়ে যায় সেটাই ভাবার বিষয়। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। অধিকন্তু, বাণিজ্যযুদ্ধ অনেক সময় পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেয়ার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। চীন এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তেমনটি হলে, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব হতে পারে বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণ যুদ্ধ এবং পরিণতি হতে পারে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। সুতরাং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নিজ নিজ দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধার কথা বিবেচনা না করে বরং বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কথা বিবেচনায় রেখে এই যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে

 

 

বাণিজ্যযুদ্ধ এক ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্ঘাত যা চরম সংরক্ষণবাদ নীতির ফলে এক দেশ প্রতিপক্ষ দেশের শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিশোধ হিসেবে ওই দেশের আমদানীকৃত পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ, বিদ্যমান শুল্ক বৃদ্ধি বা অন্য কোনোভাবে বাণিজ্য বাধার সৃষ্টি করে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাণিজ্যযুদ্ধ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং তা অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

 

 

বাণিজ্যযুদ্ধ অনেক সময় পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেয়ার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বাণিজ্য সঙ্ঘাত থেকে। দ্বিতীয় অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ হয়েছিল সমুদ্র এবং বাণিজ্য পথের আধিপত্য নিয়ে, যেখানে ইউরোপীয়দের প্রবল বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের সময়কালে ইংরেজরা চেয়েছিল বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ডাচদের আধিপত্য শেষ করে দিতে। প্রথম আফিম যুদ্ধ শুরু হয় চীন সরকার তাদের নৌবন্দর অবরুদ্ধ করে ব্রিটিশ বণিকদের বন্দী করলে, যার ফলে দ্রুত ব্রিটিশ নৌবাহিনী পাঠানো হয় এবং চীনা নৌবাহিনীর সাথে কোলনের যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ হয় বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয় বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।

 

 

 

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বাণিজ্যযুদ্ধ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে বদ্ধপরিকর। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই স্লোগান নিয়ে হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প তার বাণিজ্যিক মিত্র ও অংশীদারদের সাথে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা করছেন, নিচ্ছেন একের পর এক সিদ্ধান্ত। তার এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী দুই বড় বাণিজ্য অংশীদার দেশ কানাডা ও মেক্সিকো এবং অনেক দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের উপর শুল্কারোপ। ট্রাম্প গত ৪ মার্চ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেন মেক্সিকো এবং কানাডার ওপর। সাথে চীন থেকেও আমদানি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ওই যুদ্ধের সূচনা করে। যদিও মাত্র দু’দিন পরই তা স্থগিত করেন ট্রাম্প। আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল থাকবে তার এ স্থগিতাদেশ। ট্রাম্প বলেছেন, শুল্কারোপ শুরু হলে তা অব্যাহত থাকবে এবং পরিমাণ বাড়বে। কারণ তার মতে, চার বছর ধরে তারা আমেরিকাকে ঠকিয়েছে। ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কিছু পণ্য আমদানিতেও শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ব্রিকস অর্থনৈতিক জোটের সদস্যরা যদি ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা ব্যবহার করে তবে তাদের ওপর শতকরা ১০০ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হবে।’

 

 

ট্রাম্পের সরকার মনে করে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে ‘উন্মুক্ত দ্বার নীতি’ এবং বাণিজ্যিক শুল্ক হ্রাস নীতি চূড়ান্তভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং আমেরিকা অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে বিগত কয়েক দশকের নীতিতে পরিবর্তন করতে চাচ্ছে। এ বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য হলো, ‘আমাদের দেশ যখন শুল্ক আরোপ করেছিল তখন ধনী ছিল।’ ট্রাম্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন আমেরিকা বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ভারী শুল্ক আরোপ করেছিল।’

 

 

ট্রাম্পের মতে, এখন বাণিজ্য শুল্ক তুলে নেয়া কিংবা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার ফলে, আমেরিকা একটি রফতানিকারক দেশ থেকে প্রধান আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। যার ফলে আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলমান এই পরিস্থিতি মার্কিন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে সহনীয় নয়, যেকোনো উপায়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন করতেই হবে। তাদের মতে, এই পরিবর্তনের হাতিয়ার হলো আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো। তাদের যুক্তি, আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়লে সেটির পরিমাণ কমে যাবে এবং মার্কিন বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতিও হ্রাস পাবে। তারা আশাবাদী যে এ উপায়ে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়বে এবং মার্কিন শ্রমিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যাবে।

 

 

তবে ট্রাম্প নিজ দেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সাথে হয়ত ভুলেই গেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়কার আমেরিকা এবং এখনকার আমেরিকা এক নয়। এখন আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিশ্বে আরো অনেক জায়ান্ট দেশ সৃষ্টি হয়েছে। কানাডা, মেক্সিকো, চীন, অথবা ইইউ সদস্য দেশগুলো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ভারী শুল্ক আরোপের ফলে আমেরিকা থেকে আমদানি পণ্যের ওপরও একইরকম শুল্ক আরোপের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতেও কার্পণ্য করবে না দেশগুলো। চীন ইতোমধ্যে বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেছে। ফলে ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ কেবল আমদানীকৃত পণ্যের দামই বাড়বে না, তার রফতানি বাজারেরও ক্ষতি করবে।

 

 

কিন্তু ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধে অন্য দেশকে ঘায়েল করতে গিয়ে হয়তো ভুলেই গেছেন যে, এ যুদ্ধে আমেরিকার আমদানীকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির ফলে নিজ দেশের জিনিসপত্রের দামও বাড়বে; রফতানিরও ক্ষতি হবে।

আমেরিকার জনগণ হয়তো সরকারকে এই নীতি-পদ্ধতি পুনর্বিবেচনার জন্য চাপ দিতে পারে যা ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু এবং তা আরও তীব্র করার সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন করবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, কানাডা, মেক্সিকো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি এতটাই শক্তিশালী এবং বিশাল যে বাণিজ্যযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ওই দেশগুলো আমেরিকার শর্ত মেনে নেবে। বেইজিংয়ের ওপরও রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চাপ তীব্র করে চীনকে আমেরিকার সাথে আপস করতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

 

বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে মন্দার আশঙ্কা

এদিকে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশটিতে মন্দা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে তা নাকচ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। কারণ এখন আমেরিকায় একটি অন্তর্বর্তী সময় চলছে। আর তার প্রশাসন দেশে সম্পদ ফিরিয়ে আনার অনেক বড় কাজটি করছে। এদিকে ট্রাম্পের মতোই সম্ভাব্য মন্দার ঝুঁকি উড়িয়ে দিয়ে দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনেক বলেছেন, শুল্কারোপের ফলে বিদেশী কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে, তবে দেশে কোনো অর্থনৈতিক মন্দা হবে না। উল্টো দেশীয় পণ্যের দাম কমবে। তবে ট্রাম্প কিন্তু মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেননি।

 

 

 

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব এরই মধ্যে পড়েছে আমেরিকার শেয়ারবাজারে। ইতোমধ্যে এসঅ্যান্ডপি ফাইভ হানড্রেড ইনডেক্সে সূচক কমেছে তিন শতাংশেরও বেশি। এছাড়া আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভের মোট জিডিপি কমেছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। গোল্ডম্যান স্যাক্স পরবর্তী ১২ মাসে মন্দার শঙ্কা ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, শুল্কারোপের ফলে দাম বেশি হবে এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।

আমেরিকার বাণিজ্য বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ফ্রাঞ্চ ল্যাভিন মনে করেন বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তার পরও এটি আমেরিকার অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত বোঝা হয়েই থাকবে। কারণ চীন এরই মধ্যে আমেরিকার কৃষিপণ্যের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব কোনো একসময় দেশটির ওপর পড়বে, যা মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে।

 

 

 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের বাংলাদেশে প্রভাব

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলেও বিশ্ববাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখলে আরো অনেক দেশ এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বাণিজ্য পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিকে ধীর করবে এবং এর ফলে বৈশ্বিক কর্মসংস্থানে ও বাংলাদেশের মতো স্বল্পমাত্রায় রফতানি করে এমন দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধের কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা কোন পর্যন্ত যায় সেটি সম্পর্কে এখনই ধারণা করা কঠিন।

 

 

তবে আপাত দৃষ্টিতে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারলে বাংলাদেশ শুধু তৈরি পোশাক খাতে কিছুটা হলেও লাভবান হওয়ার সুযোগ পেতে পারে। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চীন ও ভিয়েতনাম থেকেই প্রায় ৪০ শতাংশ তৈরি পোশাক আমদানি করছে। আমেরিকার পোশাক আমদানি করা দেশের তালিকায় আরও রয়েছে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে করে আমেরিকার আমদানি মাত্র ৯ শতাংশ; টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী সাত দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং এটি বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।

 

 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের চীনা পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় চীনের তৈরী পোশাক খাতের উপরেও এর প্রভাব পড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পোশাকের রফতানি বাড়ানোর সুযোগ এনে দিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভিয়েতনামের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। সাধারণত এক দেশ অন্য দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করলে অন্যদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়, কারণ তখন বিনিয়োগকারীরা বিকল্প উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। আবার যারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে তারা ব্যবসার স্বার্থে তখন বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে কতটা সক্ষম সেই প্রশ্ন আছে। আমাদের আর্থিক খাত, গ্যাস ও বিদ্যুতের সঙ্কট এবং রিজার্ভের যে পরিস্থিতি তাতে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাই সুযোগ আসলেও কতটা সিটা নিতে পারবে সেই শঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন ও চীনের সংরক্ষণবাদ নীতি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। কারণ এতে রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে চীনা পণ্যে মার্কিন শুল্কের কারণে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের জন্য কিছু লাভ এনে দিতে পারে বলে মনে করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে এই বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

 

 

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালেও যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলে চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এতে দুই পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেবার চীনা পণ্যের ওপর প্রায় তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের শুল্ক আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে চীনও ৫৪৫টি মার্কিন পণ্যের ওপর একই রকম শুল্ক আরোপ করে। তখন চীনই বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিল। কিন্তু সেবার চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্টো বাংলাদেশের সামগ্রিক পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক ধারা ছিল ২০১৯-২০ সালে। পরে ২০২০ সালে বাণিজ্যযুদ্ধ অবসানে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে ওই দুই বছরে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমেছিল।

 

 

এক কথায় বলতে গেলে, বাণিজ্যযুদ্ধে কোন দেশ জয়লাভ করল বা হারল তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সব দেশেরই সাধারণ মানুষ হেরে যায়। কারণ মোটের উপর পণ্যের দাম যেহেতু বেড়ে যায়, তাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষরা, যারা পণ্য কেনে। আর দাম বাড়লে ক্রেতারা কম কিনে, যার ফলে বিশ্বের আমদানি-রফতানি কমে যায়। এবারের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব কতটা ব্যাপক হয় এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা কতটা বেড়ে যায় সেটাই ভাবার বিষয়। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। অধিকন্তু, বাণিজ্যযুদ্ধ অনেক সময় পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেয়ার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। চীন এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তেমনটি হলে, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব হতে পারে বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণ যুদ্ধ এবং পরিণতি হতে পারে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। সুতরাং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নিজ নিজ দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধার কথা বিবেচনা না করে বরং বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কথা বিবেচনায় রেখে এই যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট