কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল আর্কটিক

সূত্র : বণিক বার্তা, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল আর্কটিক

উত্তর আটলান্টিকের এই দ্বীপটি ভৌগোলিকভাবে উত্তর আমেরিকার অংশ হলেও রাজনৈতিকভাবে ডেনমার্কের অধীন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের 'কিনে নেওয়ার' ইচ্ছায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় এখন একটাই আলোচনা: ‘স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিক অতীত এবং মার্কিন প্রভাবের ভবিষ্যৎ’।

 

 

নুউক, গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী। এই হিমশীতল দ্বীপের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাম্প্রতিককালে অন্যরকম চাঞ্চল্য। আছে সাংবাদিকদের ভিড়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গ্রিনল্যান্ড কেনার’ আগ্রহের খবরে বিশ্বমিডিয়ার নজর এখন এই বরফাচ্ছাদিত ভূমির দিকে। ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এই বরফঢাকা দ্বীপে।

 

 


উত্তর আটলান্টিকের এই দ্বীপটি ভৌগোলিকভাবে উত্তর আমেরিকার অংশ হলেও রাজনৈতিকভাবে ডেনমার্কের অধীন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের 'কিনে নেওয়ার' ইচ্ছায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় এখন একটাই আলোচনা: ‘স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিক অতীত এবং মার্কিন প্রভাবের ভবিষ্যৎ’।

 

 


গ্রিনল্যান্ডের কৌশলগত গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টম ড্যান্স নামের এক মার্কিন বিনিয়োগকারী বলেন, ‘এটি উত্তর আমেরিকার সামরিক-অর্থনৈতিক প্রবেশপথ।’ ট্রাম্পের সমর্থক ড্যান্স, আর্কটিক অঞ্চলে যার ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। তার মতে, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। নুউক বিমানবন্দরে টেক্সাসের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ী বলছিলেন, ‘ডেনমার্কের নৌবাহিনী দুর্বল। নিরাপত্তার ভার এখনো আমেরিকার ওপরেই।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী থেকে গ্রিনল্যান্ডকে রক্ষায় মার্কিন ভূমিকার ইতিহাস টেনে এনে তিনি বর্তমান মিত্রতার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

 

 

যদিও স্থানীয়দের মনোভাব ঠিক ড্যান্সের মতো নয়। ডেনমার্কের প্রতি ক্ষোভ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, আর মার্কিন আধিপত্যের ভয়—এই তিন মিশেছে গ্রিনল্যান্ডের জনগণের প্রতিক্রিয়ায়। নুউকের রাস্তায় এক ট্যাক্সি লাইনে ডেনিশ পরামর্শক লিসবেথ হোজডাল বলছিলেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে এখানকার মানুষই। ডেনমার্ক বা আমেরিকা নয়। ‘ ডেনমার্ক প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় গ্রিনল্যান্ডকে, যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নে ব্যয় হয়। কিন্তু এই সাহায্য কি ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার?

 

 

গ্রিনল্যান্ডের ৫৭,০০০ জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশেই ইনুইট আদিবাসী। ডেনিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে নুউকের পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা হ্যানস এগেডের মূর্তি। ১৮ শতকের এই মিশনারি খ্রিস্ট ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল ইনুইটদের উপর। স্থানীয় ইনফ্লুয়েন্সার কুপানুক ওলসেনের মতে, ‘কোনো বিদেশী ঔপনিবেশিকের মূর্তি কেন আমাদের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে? আমাদের নিজেদের নায়কদের গর্ব করা উচিত।’

 

 

তার স্পষ্ট ইঙ্গিত সমুদ্রতটের দিকে—যেখানে ইনুইট পুরাণের সমুদ্রদেবী সেডনার পাথরের মূর্তি জোয়ারের পানিতে ভাসে। ওলসেনের ভাষ্যে, ‘সেডনা আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ। এগেডের মূর্তি উপড়ে ফেলতে হবে।’ তার কথায় স্পষ্ট ডেনিশ শাসনের অন্ধকার অধ্যায়গুলো এখনো ইনুইটদের তাড়া করে। গ্রিনল্যান্ড ১৯৭৯ সালে স্বায়ত্তশাসন পায়। ২০০৮ সালের গণভোটের পর আরো ক্ষমতা লাভ করে। যদিও তাদের স্বাধীনতার পথে প্রধান বাধা ডেনিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন। আগামী মাসের নির্বাচনে স্বাধীনতা ইস্যু প্রধান হবে।

 

 

কুপানুক ওলসেনের মতো স্বাধীনতাকামীরা ডেনমার্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান। কিন্তু অটাসুত পার্টির নেতা আক্কালু জেরিমিয়াসেন মনে করেন, ‘আমরা এখনো প্রস্তুত নই। ডেনমার্কের সহায়তা ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কল্যাণ রাষ্ট্র টিকবে না।’ ডেনমার্কের প্রতি ক্ষোভ স্বীকার করেও তিনি বলেন, ‘অতীতকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।’

 

 

অন্যদিকে, ‘ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ডের সন্তান' খেতাব পাওয়া জর্জেন বোয়াসেন মার্কিন মিত্রতা চান। তবে তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হতে রাজি নন। তার মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র শুধু আমাদের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, খনিজ সম্পদে সাহায্য করুক।’ যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে উত্তাল রাজনীতির প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয়রা বলছেন, ‘দুর্গে জোক ঢুকলে জোক রাজা হয় না, বরং দুর্গ সর্কাসে পরিণত হয়।’

 

 

গ্রিনল্যান্ডে ইউরেনিয়াম, রেয়ার আর্থ মিনারেলের বিশাল মজুদ রয়েছে, যা স্মার্টফোন থেকে যুদ্ধবিমান—সবই তৈরি করতে প্রয়োজন। চীন বর্তমানে এই বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থুলে এয়ার বেসের মাধ্যমে আর্কটিক নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ট্রাম্প চান গ্রিনল্যান্ডকে সরাসরি হস্তগত করতে। তবে স্থানীয়দের একটি বড় অংশ নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি চায় না। ওলসেনের ভাষায়, ‘আমরা ইনুইট। আমাদের পরিচয়ে গর্ব করব। কেন আরেকজন বিদেশী শাসক চাইব?’

 

 

নভেম্বরে গ্রিনল্যান্ডের সংসদ নির্বাচন, যেখানে স্বাধীনতা প্রশ্নে জনমত পরিষ্কার হতে পারে। সম্প্রতি বিদেশি অর্থায়নে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছে তারা। এটি কি ট্রাম্প-সমর্থকদের প্রভাব কাটানোর চেষ্টা? আর্কটিকের বরফ যেমন গলে যাচ্ছে, তেমনি গলছে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের বাঁধন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন মানে আর্থিক অনিশ্চয়তা সঙ্গে প্রতিরক্ষার চ্যালেঞ্জ—সে জন্য গ্রিনল্যান্ড কতটা প্রস্তুত?