কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আমরা যে টানাপড়েন দেখতে পারি

ড্যানি রডরিক । সূত্র : বণিক বার্তা, ০৬ মার্চ২ ০২৫

ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আমরা যে টানাপড়েন দেখতে পারি

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন তথাকথিত এলিটদের" বিরুদ্ধে গণরায়ের এক প্রবল ঢেউয়ের ওপর ভর করে। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে তার সমর্থকরা নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও ধনিক শ্রেণীর (এস্টাবলিশমেন্ট) শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে। প্রথম মেয়াদের মতো এবারো ট্রাম্প—ধনী ব্যবসায়ী ও সেলিব্রিটি হিসেবে নিজেকে ঘিরে রেখেছেন প্রচলিত রিপাবলিকান রাজনীতিক, ওয়াল স্ট্রিটের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে। তবে এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টেকনো-রাইট"বা প্রযুক্তিবান্ধব ডানপন্থী গোষ্ঠী, যার সবচেয়ে বড় মুখ ইলোন মাস্ক—বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি।

 

  • এ দলগুলোর এক হওয়ার কারণ ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব বা নেতৃত্ব নয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। বরং তারা মনে করে, ট্রাম্পের অধীনে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা পাবে। রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা চান কম কর ও শিথিল নিয়ম-কানুন, অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীরা চান বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে। বাক-স্বাধীনতার চরমপন্থী সমর্থকরা চান তথাকথিত ‘উক সেন্সরশিপ’র অবসান, আর টেকনো-রাইট গোষ্ঠী চায় ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত রূপান্তর তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকুক।

 

  • নিজেদের এসব এজেন্ডার কারণে তারা কমলা হ্যারিস (এবং জো বাইডেনকেও) বাধা হিসেবে দেখেছে, আর ট্রাম্পকে সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের বেশির ভাগই গণতন্ত্রের বিরোধী নয়, কিন্তু ট্রাম্পের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব বা আইনের প্রতি তার অবজ্ঞাকে তারা সহজেই উপেক্ষা করে, যদি তাদের লক্ষ্য পূরণ হয়। যদি ট্রাম্পের গণতন্ত্রবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের চাপ দেয়া হয়, তাহলে তারা কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যায় বা গুরুত্ব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে।

 

  • ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে, আমি তার এক শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টার (একজন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী) সঙ্গে আমার উদ্বেগ শেয়ার করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে ডেমোক্র্যাট ও প্রশাসনিক কাঠামোই বড় বিপদ। তিনি মূলত ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিলেন, গণতন্ত্রের সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টি তার কাছে গৌণ ছিল।

 

  • নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক এজরা ক্লেইনের সাম্প্রতিক এক পডকাস্টে, বাকস্বাধীনতার একনিষ্ঠ সমর্থক মার্টিন গুরি ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন। তার মতে, বাইডেন প্রশাসন বাকস্বাধীনতার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। গুরির দাবি, বাইডেন মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে তাদের ইউরোপীয় মানের অনলাইন আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। অথচ ট্রাম্প এরই মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরো কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন, যা অধিকতর দমনমূলক।

 

  • গুরি স্বীকার করেন যে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত "আরো খারাপ" হতে পারেন, তবে তবু তিনি উদ্বিগ্ন নন। যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা আসে, তখন তার কাছে ‘সেন্সরশিপের কড়াকড়ি’ ধ্বংস করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এমনকি তা যদি মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর (ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট) সুরক্ষা দুর্বল করে দেয় তবুও।

 

  • ট্রাম্পের প্রভাবশালী সমর্থকরা যখন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থকে গণতান্ত্রিক নীতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হওয়ার ঝুঁকি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে আরো সম্ভাব্য পরিণতি হলো, এ ভিন্ন এজেন্ডাগুলোর কারণে অচিরেই ট্রাম্পপন্থী জোটে ভাঙন দেখা দিতে পারে।

 

  • সবচেয়ে তীব্র সংঘাত হবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীদের (economic nationalists) ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ডানপন্থীদের (টেকনো-রাইট) মধ্যে। উভয় পক্ষই নিজেদের প্রথাগত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী"বলে মনে করে এবং তারা বিশ্বাস করে যে ডেমোক্রেটিক পার্টির এলিটরা তাদের ওপর একটি ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে, যা তারা ভাঙতে চায়। তবে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আমেরিকা চায়।

 

  • অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীরা এক কল্পিত অতীতে ফিরে যেতে চায়, যেখানে আমেরিকার শিল্প খাত ছিল স্বর্ণযুগে। অন্যদিকে প্রযুক্তিবান্ধব ডানপন্থীরা এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে।

 

  • এক পক্ষ জনতার সাধারণ জ্ঞান ও বিবেকের ওপর আস্থাশীল, অন্য পক্ষ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এক দল চায় অভিবাসন পুরোপুরি বন্ধ হোক, অন্য দল দক্ষ কর্মীদের স্বাগত জানায়। এক পক্ষ সংকীর্ণ ও জাতীয়তাবাদী, অন্য পক্ষ মূলত বিশ্বায়নের পক্ষে। এক দল চায় সিলিকন ভ্যালিকে ভেঙে দিতে, অন্য দল চায় একে আরো শক্তিশালী করতে। এক দল চায় ধনীদের ওপর করের বোঝা চাপাতে, অন্য দল চায় ধনীদের আরো বেশি সুবিধা দিতে।

 

  • এ ভিন্নমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্ব অচিরেই ট্রাম্পপন্থী জোটের ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে পারে এবং তার রাজনৈতিক জোট ভেঙে পড়তে পারে।

 

  • জাতীয়তাবাদী-পপুলিস্টরা দাবি করে যে তারা সেই সাধারণ জনগণের পক্ষে কথা বলছে, যাদের ইলোন মাস্কের কল্পিত প্রযুক্তিগত বিপ্লব পেছনে ফেলে দেবে। তাই তাদের মধ্যে সিলিকন ভ্যালির তথাকথিত “প্রযুক্তি সামন্তবাদীদের” (technofeudalists) প্রতি গভীর অবজ্ঞা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম নেতা স্টিভ ব্যানন (যিনি অবশ্য হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে স্নাতক) এতদূর পর্যন্ত গেছেন যে তিনি মাস্ককে “পরজীবী অবৈধ অভিবাসী” বলে অভিহিত করেছেন। ব্যানন হুঁশিয়ার করেছেন যে মাস্ক ও তার প্রতিনিধিত্ব করা প্রযুক্তিগত অভিজাতদের “থামাতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা যদি এখনই তাদের থামাতে না পারি, তারা শুধু আমেরিকাই নয়, পুরো বিশ্বকে ধ্বংস করে দেবে।”

 

  • ব্যানন বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনে কোনো পদে নেই, তবে তিনি মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (MAGA) আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং প্রশাসনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অন্যদিকে এটি স্পষ্ট যে ট্রাম্পের ওপর মাস্কের প্রভাব এখন বেশি। হোয়াইট হাউজ তাকে তথাকথিত গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বিভাগ (ডিওজিই) পরিচালনার ব্যাপারে অবাধ নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে এবং ট্রাম্প নিজেও মাস্ককে আরো আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করেছেন।

 

  • ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতাদের ক্ষেত্রে তাদের আশপাশের অনুসারীদের (বা দরবারিদের) একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা সাধারণ ব্যাপার। এতে কেউই অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না, আর ট্রাম্প নিজের অবস্থান শীর্ষে রাখতে পারেন। তবে এ কৌশল তখনই কার্যকর হয়, যখন প্রতিযোগিতা শুধু সরকারি সম্পদ ও সুযোগসুবিধা দখলের জন্য হয়, আদর্শগত ও মতাদর্শগত সংঘর্ষের জন্য নয়।

 

  • ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরে সক্রিয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিপরীত বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত অবস্থান বিবেচনায় এ সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠছে। কিন্তু এরপর কী হবে? প্রশাসন কি অচল হয়ে পড়বে, নাকি কোনো একটি গোষ্ঠী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে? ডেমোক্র্যাটরা কি এ বিভাজনকে কাজে লাগাতে পারবে? ট্রাম্পবাদ কি কলঙ্কিত হবে? নাকি আমেরিকান গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকার হয়ে যাবে?

 

  • যে ফলাফলই আসুক না কেন, সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয় হলো, ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচরণকারী এলিটদের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে প্রকৃত পরাজিত হবে সেই কম শিক্ষিত শ্রমজীবী শ্রেণী, যারা তার এলিটবিরোধী বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়েছিল। ট্রাম্পপন্থী জোটের কোনো অংশই তাদের জন্য কার্যকর নীতি বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেনি। এমনকি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীরাও (তাদের ভাষণ ও প্রচারণার বিপরীতে) সেই শ্রমজীবী শ্রেণীর জন্য বাস্তবসম্মত কোনো সমাধান দিতে পারেনি, কারণ তাদের পুরো আশা একটি অবাস্তব শিল্পায়ন পুনরুত্থানের ওপর নির্ভরশীল।

 

  • যখন বিভিন্ন ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবে, তখন একটি পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজে মধ্যবিত্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগুলো আরো দূরবর্তী ও অবাস্তব রয়ে যাবে।

 

ড্যানি রডরিক: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট