কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের কারণে বিশ্বপ্রগতির ধারা কি থমকে যাবে

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ট্রাম্পের অধীনে এই নেতৃত্বের ধারা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি না এবং ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ বিশ্বব্যবস্থায় কী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ- জোসেফ ই. স্টিগলিৎস । সূত্র : প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের কারণে বিশ্বপ্রগতির ধারা কি থমকে যাবে

৩৫ বছর আগে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছিল। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তখন এটিকে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সব দেশ ধীরে ধীরে গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে।

 

 

কিন্তু আজকের বাস্তবতা দেখলে বোঝা যায়, ফুকুয়ামার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল ছিল। আজকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) আন্দোলন যে ভঙ্গিতে ফিরে এসেছে, তা দেখে আমরা এখনকার সময়কে হয়তো ‘প্রগতির সমাপ্তি’ বলে অভিহিত করতে পারি।

 

 

আমরা সাধারণত মনে করি, উন্নয়ন সহজাতও স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আড়াই শ বছর আগের মানুষের জীবনযাত্রা কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগের মানুষের জীবনযাত্রার চেয়ে খুব বেশি উন্নত ছিল না। আদতে মানবজীবনযাত্রার প্রকৃত পরিবর্তন এসেছে আলোকিত যুগ (এনলাইটেনমেন্ট) ও শিল্পবিপ্লবের পর; যখন মানুষের আয়ু, স্বাস্থ্য ও জীবনমান নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়।

 

 

আলোকিত যুগের চিন্তাবিদেরা বুঝতে পারেন, বিজ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃতিকে ভালোভাবে বোঝা সম্ভব এবং এর মাধ্যমেই নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করা যায়। পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে এবং এর মাধ্যমে সবার জীবনমান উন্নত হয়।

সমাজের এই সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন এমন আইনের শাসন, যেখানে একক শাসকের ক্ষমতা থাকবে সীমিত; যেখানে সত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং যেখানে বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানকে সম্মান করা হবে। কিন্তু ট্রাম্পের মাগা আন্দোলনের অন্যতম ভয়ংকর দিক হলো—এই মূল্যবোধগুলোকে সরাসরি অস্বীকার করা।

 

 

তাহলে কি মানবসমাজের অগ্রগতি বা প্রগতি অব্যাহত থাকতে পারবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন একসময় যেমন স্পুতনিক উৎক্ষেপণ করে হইচই ফেলে দিয়েছিল, তেমনই ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরা হয়তো মহাকাশ গবেষণা বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কিছু বড় সাফল্য আনতে পারেন। কিন্তু তাঁরা কি সত্যিই এমন উন্নয়ন করতে পারবেন, যা সবার জন্য কল্যাণকর হবে?

বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা শুধুই সম্পদ বাড়ানোর চিন্তা করছে। শোষণ ও অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে তারা কোনো দ্বিধা করে না। তারা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, কীভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা যায়।

 

 

আগের তুলনায় আজকের আমেরিকান দুর্নীতি অনেক বড় এবং প্রকাশ্য। আগে ঘুষ দেওয়া হতো লুকিয়ে, হয়তো একটা খামের ভেতরে ডলারের নোট ভরে। কিন্তু এখন ধনী ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী প্রচারে শত শত মিলিয়ন ডলার দান করতে পারেন এবং এর বিনিময়ে তাঁরা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

আমেরিকান অলিগার্করা প্রকাশ্যে একজন রাজনীতিবিদের নির্বাচনী প্রচারের জন্য শত শত মিলিয়ন ডলার ‘চাঁদা’ দিয়ে ‘অবদান’ রাখতে পারেন। এর বিনিময়ে তাঁরা নানা ধরনের বিশেষ সুবিধা হাতিয়ে নেন।

 

 

২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার পর সে সময়কার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন ইলেকট্রিক গাড়ির উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য টেসলাকে ৪৬৫ মিলিয়ন ডলারের একটি শর্তহীন ঋণ দিয়েছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের লেনদেনের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে এবং ধনকুবেরেরা রাজনীতিবিদদের অর্থ দিয়ে কিনে নেবেন, যাতে তাঁরা তাঁদের জন্য আরও বড় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন। অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।

 

 

প্রগতি ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞানের উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে গবেষণার জন্য বরাদ্দ তহবিলে এত বড় কাটছাঁটের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তাঁর নিজের দলের রিপাবলিকানরাও এতে আপত্তি করেছিলেন। এবারও কি তাঁরা একইভাবে ট্রাম্পকে বাধা দিতে পারবেন?

প্রশ্ন হলো, যখন শিক্ষার উন্নয়ন ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার আক্রমণের শিকার হয়, তখন কি সত্যিই অগ্রগতি বা প্রগতি সম্ভব? যেসব গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে প্রগতি ও অগ্রগতিবান্ধব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়, সেসব নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করাকে এখন মাগা আন্দোলন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

 

 

একটি দেশ কখনোই উন্নতি করতে পারে না, যদি তার বেশির ভাগ মানুষ ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিকর খাবার না পায়। আমেরিকায় প্রায় ১৬ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়। সেখানে এখন শিক্ষার মান আন্তর্জাতিকভাবে গড়পড়তা। সেখানে অপুষ্টি ও গৃহহীনতা বাড়ছে। সেখানে মানুষের গড় আয়ু উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে কম।

এর সমাধান হলো জনপরিষেবা খাতে আরও বেশি ও ভালো সরকারি খরচ বরাদ্দ করা। কিন্তু ট্রাম্প ও তাঁর অলিগার্করা তা না করে উল্টো বাজেট ছাঁটাই করতে চান। এতে আমেরিকা বিদেশি শ্রমের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কিন্তু ট্রাম্পের সমর্থকেরা অভিবাসীদের, এমনকি তাঁরা দক্ষ কর্মী হলেও তাঁদের পছন্দ করেন না।

 

 

 

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে এলেও ট্রাম্পের অধীনে এই নেতৃত্বের ধারা কীভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তা বোঝা কঠিন। আমি আমার কল্পনায় তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি দেখতে পাই।

 

 

আমার কল্পিত প্রথম পরিস্থিতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা স্বীকার করবে এবং মাগা আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করবে। যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের প্রভাব খর্ব করে আবারও আলোকপ্রাপ্তির যুগের (এনলাইটমেন্ট) মূল্যবোধগুলো (যেমন: বিজ্ঞান, যুক্তি এবং জনকল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি) অনুসরণ করবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র আবার বৈশ্বিক নেতৃত্বের দিকে ফিরে আসবে এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।

 

 

দ্বিতীয় পরিস্থিতি হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের পথে চলতে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রে অলিগার্কদের পুঁজিবাদ বৃদ্ধি পাবে, আর চীনে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও কর্তৃত্ববাদী শাসন চলতে থাকবে। এর ফলে পৃথিবীজুড়ে অন্য দেশগুলো পিছিয়ে পড়বে এবং বিশ্বে মূলত দুটি শক্তিশালী দেশ—যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—এগিয়ে থাকবে।

 

 

তৃতীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের বর্তমান ধারাতেই চলতে থাকবে। তবে ইউরোপে পরিবর্তন আসবে। ইউরোপ প্রগতিশীল পুঁজিবাদ এবং সামাজিক গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবে, যা মানুষের কল্যাণ এবং সমতা নিশ্চিত করবে। এর ফলে ইউরোপ হয়তো বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিতে পারে।

 

 

দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয় পরিস্থিতিটিকেই আমার সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নিজেদের পথেই চলতে থাকবে এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলো তাদের কাছ থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে। চীন প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকবে। কারণ, সেখানে বিশাল বাজার, বহুসংখ্যক দক্ষ প্রকৌশলী, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং ব্যাপক নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

 

 

চীনের কূটনীতি পশ্চিমের বাইরে থাকা ৬০ শতাংশ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি সফল হয়েছে। তবে চীন বা ট্রাম্পীয় আমেরিকা কোনোভাবেই সেই মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়, যা গত ২০০ বছরে উন্নতির পথ দেখিয়েছে। দুঃখজনকভাবে আজ মানবতা বড় বড় সমস্যা নিয়ে লড়ছে। প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের নিজেদের ধ্বংসের পথ করে দিয়েছে। আর একমাত্র আন্তর্জাতিক আইনই আমাদের এই বিপদে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মহামারির হুমকি ছাড়াও এখন আমাদের অনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।

 

 

কিছু মানুষ বলবেন, যদিও অগ্রগতি কিছুটা থেমে গেছে, তবে অতীতে করা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল এখনো আসছে। কিছু আশাবাদী বলবেন, যেকোনো স্বৈরশাসন একসময় না একসময় শেষ হয়, আর ইতিহাস চলতে থাকে। এক শতক আগে, ফ্যাসিবাদ পুরো পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করেছিল; কিন্তু তার পরেই গণতন্ত্রের ঢেউ এসেছিল।

কিন্তু সমস্যা হলো আগেকার সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো সীমিত ছিল; আর এখন আমাদের হাতে সময়ও আছে খুব কম। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে না।

 

 

সে কারণে প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্র কি সবার জন্য সমান সুযোগ রাখা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পরিষ্কার পরিবেশের মতো বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে উন্নতি করবে? এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আর আমেরিকায় এসব অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার প্রভাব অন্য দেশেও পড়বে, এটা নিশ্চিত।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে এখনই সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সত্যিটা হলো, ইতিহাস সত্যিই চলতে থাকে; তবে সেই চলার পথে সে অনেক সময় প্রগতিকে পেছনে ফেলে রেখে যেতে পারে।

 

 

  • জোসেফ ই. স্টিগলিৎস বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ; মার্কিন প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।