কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর মানুষের অনেক আশঙ্কাই বাস্তবে ঘটতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি বাইডেন প্রশাসনের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ বাতিল করে এবং নতুন করে দুই শতাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে নিজের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত শুধু মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যে চারটি সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

 


ট্রাম্পের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি করছে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গৃহীত ‘প্যারিস চুক্তি’ থেকে বেরিয়ে আসা। এই চুক্তিটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। চুক্তি থেকে সরে আসার মাধ্যমে ট্রাম্প দেখিয়েছেন যে মার্কিন অর্থনীতির স্বার্থ জলবায়ু সংকট মোকাবেলার চেয়ে তাঁর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

 


বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সিদ্ধান্তের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ, যে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, এই সিদ্ধান্তের কারণে আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন কমিয়ে দিলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজন এবং পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

 

 

ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বেরিয়ে আসা। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ডব্লিউএইচও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় সংস্থাটির তৎপরতা এবং সহযোগিতা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ডব্লিউএইচও হলো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্তের প্রভাব হবে বিশাল।

 

 

উদাহরণস্বরূপ, ডব্লিউএইচও বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচি এবং মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে এসব কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হবে। কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে পুনর্গঠনের প্রয়োজন, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রধান দাতা দেশ ডব্লিউএইচও থেকে সরে আসার ফলে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হবে, যা সরাসরি দরিদ্র দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ, যা জনস্বাস্থ্য খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, এই সিদ্ধান্তের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 


বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার পরিমাণ হ্রাস করা ট্রাম্পের আরো একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা প্রদানের শীর্ষে ছিল। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটে, বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণে মার্কিন সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সব সময়ই ছিল উল্লেখযোগ্য।

 

 

তবে সহায়তার পরিমাণ কমে গেলে কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জন্য মৌলিক সেবা প্রদান আরো কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সহায়তা হ্রাস পেলে বাংলাদেশ, সিরিয়া, ইউক্রেনসহ অনেক দেশকে এককভাবে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে, যা অত্যন্ত কঠিন। এর ফলে মানবিক সংকট আরো প্রকট হবে, যা আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্ত শুধু অভিবাসীদের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী অভিবাসন নীতিতে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। বিপুলসংখ্যক অভিবাসী, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন বা তাঁদের সন্তানরা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পেয়েছে, তারা এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সিদ্ধান্ত অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং ভয় বাড়িয়ে তুলেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীসমাজ এবং তাদের অর্থনৈতিক অবদানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

 

 

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তগুলো শুধু মার্কিন অভ্যন্তরীণ নীতিতে নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ধারণাকে দুর্বল করছে এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা এবং ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে যাওয়া ট্রাম্প প্রশাসনের একপক্ষীয়তাবাদকে স্পষ্ট করেছে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন বিশ্বনেতৃত্বে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

 

অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি প্রতিরোধ এবং মানবিক সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে যেখানে বৈশ্বিক সহযোগিতা অপরিহার্য, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিচ্ছিন্ন নীতি পুরো বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ট্রাম্পের এই নীতিগুলো বাংলাদেশের জন্য দ্বৈত প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে রোহিঙ্গা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে বাংলাদেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে এই নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

 

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং মানবিক সংকটের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাঁর নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে, যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে।

 

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, বিকল্প সহযোগিতা খোঁজা এবং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে।

 

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়