কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর : কুকুর লেজ নাড়ছে, নাকি লেজ কুকুরকে

সামি আল-আরিয়ান [সূত্র : প্রথম আলো, ২৬ মে ২০২৫]

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর : কুকুর লেজ নাড়ছে, নাকি লেজ কুকুরকে

গত সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর (যার মধ্যে ছিল সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) তাঁর আগের ইসরায়েল–ঘেঁষা অবস্থান থেকে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।

 

 

সফরের আগে ট্রাম্প হুতিদের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সমঝোতা করেন। ওই সমঝোতায় ইয়েমেনের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের ওপর হামলা বন্ধের কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে তিনি হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার অনুমতি দেন। সে আলোচনায় একটি মার্কিন-ইসরায়েলি বন্দিমুক্তির বিনিময়ে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

 

 

ইসরায়েলের দিক থেকে স্পষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত আসলে কে নেয়—ওয়াশিংটন নাকি তেল আবিব?

 

 

এই প্রশ্ন বহু বছর ধরেই ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।

 

 

অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আসলে ইসরায়েলপন্থী লবি নিয়ন্ত্রণ করে। এই লবির মূল লক্ষ্য ইসরায়েলি স্বার্থ পূরণ করা।

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জন মিয়ারশেইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট, তাঁদের বিখ্যাত বই দ্য ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসিতে এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন।

 

শকের নানা উদাহরণ তুলে ধরেছেন। সেসব উদাহরণ দেখায় কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলপন্থী লবি, বিশেষত কংগ্রেসে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং একের পর এক প্রশাসনের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে আসছে।

 

 


উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা উল্লেখ করেন, ইসরায়েলপন্থী লবি ও নব্য রক্ষণশীলদের প্রভাব ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সিদ্ধান্তে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল।

 

 

সাংবাদিক জে জে গোল্ডবার্গ তাঁর ‘জুইশ পাওয়ার’ বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ইসরায়েলি স্বার্থ রক্ষায় প্রভাবশালী লবি কাজ করে এবং তাদের ক্ষমতার গঠন ও কার্যপ্রণালী কী।

 

 

এই লবির প্রভাব আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বিখ্যাত ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে। তাঁর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে জায়নাবাদী লবি শত বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত করেছে ও নিয়ন্ত্রণ করেছে।

 

 

অন্যদিকে মার্কিন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি একাধিক বইয়ে লিখেছেন, আসলে যুক্তরাষ্ট্রই জায়নাবাদী শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য। চমস্কির মতে, ইসরায়েল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাতিয়ার, যার মাধ্যমে তারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং বৃহত্তর বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখে।

 

 

এই ব্যাখ্যার পক্ষে ঐতিহাসিক নজিরও রয়েছে। যেমন ১৯৫৬ সালে ইসরায়েল, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মিলে মিসরে হামলা চালায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার নিজে নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলকে সিনাই উপত্যকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

 

 

আরেকটি উদাহরণ ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ। তখন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্পষ্টভাবে বলেছিল, ইরাকের স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে তারা যেন প্রতিক্রিয়া না জানায়, যাতে আরব মিত্ররা ক্ষিপ্ত না হয়।

 

 

এই সব নজির আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মধ্যপ্রাচ্যে সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়, তা বোঝার জন্য একটি প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ: কে কাকে চালায়? ইসরায়েল কি সেই ‘লেজ’, যা ‘কুকুর’ যুক্তরাষ্ট্রকে নাড়ায়? নাকি বরং যুক্তরাষ্ট্রই সেই শক্তিমান কুকুর, যার হাতে ইসরায়েল নামের লেজটি ধরা?

 

 

ইসরায়েল এই দুটি চুক্তিরই বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারা কিছু করতে পারেনি। যদি এটি কোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট করতেন, তাহলে নেতানিয়াহু রিপাবলিকানদের সমর্থন নিয়ে হয়তো চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যেহেতু এটি এসেছে রিপাবলিকান সরকারের পক্ষ থেকে এবং ইসরায়েল এতে নেই, তাই তিনি কিছুই করতে পারেননি।

 


২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ‘তুফান আল-আকসা’ হামলার পর, ইসরায়েল এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে গাজায় যে যুদ্ধ শুরু করেছে, সেটি কার্যত গণহত্যা ও জাতিগত নিধন অভিযানে রূপ নিয়েছে।

 

 

এই যুদ্ধের মাধ্যমে তারা কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। তারা দীর্ঘ মেয়াদে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা হ্রাস করে ডেমোগ্রাফিক সমস্যার সমাধান করতে চায়; তারা পশ্চিম তীরে আগ্রাসী বসতি স্থাপন ও জমি দখল চালিয়ে এমন বাস্তবতা তৈরি করতে চায়, যাতে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয়।

 

 

এই পুরো সময় (প্রায় ১৫ মাস ধরে) যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন এমন একটি নীতি অনুসরণ করেছে, যা ইসরায়েলের অবস্থান থেকে আলাদা ছিল না; বরং তারা ইসরায়েলের আগ্রাসনের গণহত্যামূলক চরিত্রকেই সরাসরি টিকিয়ে রেখেছে।

 

 

এই নীতি ইসরায়েলপন্থী লবির চাপের কারণে হয়েছে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এতে আসল বিষয় বদলায় না।

 

 

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একবার স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল না থাকলে আমাদের একটি ইসরায়েল তৈরি করতে হতো।’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের জন্য একটি শক্তিশালী জায়নাবাদী শাসনের প্রয়োজন হয়, যেন সেটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে।

 

 

এই যে যুক্তরাষ্ট্র আজ ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, এটা নতুন কিছু নয়। বরং শুরু থেকেই জায়নাবাদী নেতারা বুঝে নিয়েছিলেন, ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রকল্প কাকে এবং কীভাবে উপকার দেবে।

 

 


প্রথম জায়নাবাদী প্রেসিডেন্ট চাইম ওয়েইজম্যান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘একটি ইহুদি ফিলিস্তিন হবে ইংল্যান্ডের জন্য এক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, বিশেষ করে সুয়েজ খাল সংরক্ষণের দিক থেকে...যদি আমরা ইংল্যান্ডের জন্য ফিলিস্তিনের এক খণ্ড জমি না জুগিয়ে দিতাম, তাহলে কেবল ইংল্যান্ড নয়, সমগ্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক শক্তির অবস্থান কী হতো, সেটা ভেবে দেখা উচিত।’

 

 

অর্থাৎ জায়নাবাদী প্রকল্প শুরু থেকেই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে গড়া। পরে এই প্রকল্পই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়।

 

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় শুরু হওয়া গণহত্যা ও আগ্রাসনের পুরো সময়জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সব রকম সহায়তা দিয়ে গেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ‘বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার রক্ষক’ হিসেবে তাদের অবস্থানও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

 

 

তবে এটা অস্বীকার করা অবান্তর যে জায়নাবাদী লবি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বিশাল প্রভাব রাখে। তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়: ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে চালায়, না যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে?

 

 

এই বিতর্ক আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।

 

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করেন ‘পরীক্ষিত একজন বন্ধু’ হিসেবে; যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ইসরায়েলপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

 

ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১) জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন (যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতির পরিপন্থী); মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেন এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের ‘সার্বভৌমত্বের’ স্বীকৃতি দেন (যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন)।

 

 

ট্রাম্প ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করতে ওয়াশিংটনে পিএলওর অফিস বন্ধ করে দেন; পিএ, ফিলিস্তিনি এনজিও, দাতব্য সংস্থা ও শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেন।

 

 

মনে রাখতে হবে, এই পিএলও-ই ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত শান্তিপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দিয়েছিল, যার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে নিজেদের দখল আরও মজবুত করে।

 

 

ট্রাম্প একজন লেনদেনকামী প্রেসিডেন্ট। তিনি নিজের ‘মাগা’ সমর্থকদের দেখাতে চান, তিনি ফলদায়ী, বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি নেতানিয়াহুর পুরোনো প্রতিশ্রুতি (‘ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে চূর্ণ করা’) নিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চান না, কারণ বারবারই এই প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হয়েছে।

 

 

২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রশাসন যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করিয়েছিল, তা ইসরায়েল ভঙ্গ করে ১৮ মার্চ থেকে আবার গণহত্যা শুরু করে।

তখন ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে আরও দুই মাস সময় দেন লক্ষ্য অর্জনের জন্য। কিন্তু সেগুলোও পূরণ হয়নি।

 

 

পরিণামে, ৭ এপ্রিল হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সফরের সময় ট্রাম্প হঠাৎ ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় যাচ্ছে।

 

 


নেতানিয়াহু তখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজের সঙ্গে মিলে ইরানে সামরিক হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তা নাকচ করে দেন, ওয়াল্টজকে পদচ্যুত করেন এবং কূটনৈতিক পথ বেছে নেন। এটি নেতানিয়াহুকে হতাশ করে।

 

 

সেই একই সফরে নেতানিয়াহু সিরিয়া–বিষয়ক নীতির জন্য ট্রাম্পের সমর্থন চান। ইসরায়েল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পর থেকেই সিরিয়ায় নতুন আগ্রাসন চালাচ্ছে।

 

 

তারা প্রথমে সিরিয়ার বাকি সামরিক সম্পদ ধ্বংস করে। তারপর বিমান হামলা ও স্থল আগ্রাসনে ৪০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি জমি দখল করে নেয়। আর আগে থেকেই তারা গোলান মালভূমির ১ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার দখলে রেখেছিল।

 

 

এই দখলদারির মূল উদ্দেশ্য কেবল সিরিয়াকে দুর্বল করা নয়, বরং দেশটিকে ভেঙে চারটি জাতিগত-গোষ্ঠীগত অঞ্চলে ভাগ করে ফেলা। অঞ্চলগুলো হলো দ্রুজ, আলাবি, কুর্দি ও সুন্নি।

 

 

কিন্তু এই বিপজ্জনক পরিকল্পনা সরাসরি তুরস্কের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যায়। সিরিয়ায় শাসন পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে তুরস্ক। তাই তারা নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। অথচ এদিকে ইসরায়েলের একাধিক মন্ত্রী তুরস্ককে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন।

 

 

কিন্তু নেতানিয়াহুর জন্য সবচেয়ে বড় চমক ছিল—ট্রাম্প তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পক্ষ নিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, ট্রাম্প ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি অংশ উত্তর সিরিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে বলেন, তুরস্কের সঙ্গে বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে হবে এবং সমঝোতায় আসতে হবে।

 

 

গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে নীতিগত মতবিরোধ ছিল খুবই বিরল। কিন্তু ট্রাম্পের অবস্থান ইসরায়েলকে বাধ্য করে তারা যেন সিরিয়া নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনায় বসে, যাতে কোনো সংঘর্ষ বা যুদ্ধ না হয়।

 

 

এর পাশাপাশি, ইসরায়েলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ট্রাম্প ঘোষণা দেন—সিরিয়ার ওপর আর কোনো মার্কিন বা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। এ ঘোষণাটি তিনি দেন সৌদি আরব সফরের সময়। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও এরদোয়ানের প্রবল তদবিরের পরেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন।

 

 

এই সিদ্ধান্তে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক লক্ষ্যও ভূমিকা রেখেছে। তিনি তাঁর সমর্থকদের সামনে নিজেকে সফল হিসেবে তুলে ধরতে চান। এ জন্য তিনি উপসাগরীয় অঞ্চলে ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি ও বাণিজ্যিক চুক্তির দিকে ঝুঁকেছেন।

 

 

কিন্তু সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা চলতে থাকলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না। তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও একটি বেসামরিক নিউক্লিয়ার চুল্লির দাবি তোলে। বাইডেন প্রশাসন মাসের পর মাস এই চুক্তির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়, কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে রাজি হয়নি।

 

 

কিন্তু ট্রাম্প এসব শর্ত বাদ দিয়ে সরাসরি সৌদি আরব সফর করেন। সেখানে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন (১৪২ বিলিয়ন ডলারের)। একই সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক চুল্লির বিষয়েও চুক্তি হয়।

 

 

ইসরায়েল এই দুটি চুক্তিরই বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারা কিছু করতে পারেনি। যদি এটি কোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট করতেন, তাহলে নেতানিয়াহু রিপাবলিকানদের সমর্থন নিয়ে হয়তো চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যেহেতু এটি এসেছে রিপাবলিকান সরকারের পক্ষ থেকে এবং ইসরায়েল এতে নেই, তাই তিনি কিছুই করতে পারেননি।

 

 

ট্রাম্প ইসরায়েলকে আরও এক ধাক্কা দেন ৬ মে। তিনি ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। সেখানে হুতিদের ইসরায়েলবিরোধী হামলা বন্ধ করার কোনো শর্ত ছিল না।

 

 

হুতিরা গাজায় গণহত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা থামাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এই ফ্রন্টে ইসরায়েলকে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেন।

 

 

দুই দলই (রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট) এত দিন একই নীতি মেনে চলেছে। হামাস বা হিজবুল্লাহর মতো রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠন দমনে ইসরায়েলকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়ে উভয়েই একমত ছিল। কারণ, এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থ জড়িত।

 

 

তবু ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে কয়েক মাস সময় দিয়েছিলেন গাজায় একটি গণহত্যামূলক অভিযান চালানোর জন্য। এর মধ্যে ছিল নির্বিচার বোমাবর্ষণ এবং ২ মার্চ থেকে খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানি বন্ধ রেখে ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে অনাহারে রাখার নীতি।

 

 

তবে ট্রাম্প নিজে একজন ‘ডিল-মেকার’ হিসেবে গাজায় আটক ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির বিষয়টিকে তাঁর কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে লুফে নিতে চেয়েছিলেন। তিনি বন্দিমুক্তির বিনিময়ে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

 

 

কিন্তু নেতানিয়াহু তাঁর চরম জেদের কারণে এই সুযোগও নিতে চাননি। তিনি বারবার দাবি করেন, ‘পুরোপুরি বিজয়’ ছাড়া তিনি থামবেন না। এটি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করেছে এবং বন্দীদের জীবন আরও বিপন্ন করেছে।

 

 

ট্রাম্প প্রশাসন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর ইসরায়েলপন্থী লোকজন দিয়ে ভরা। ফলে ট্রাম্পের হাত ধরে আসা এই পরিবর্তনগুলো আদৌ দীর্ঘমেয়াদি কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

 

 

সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের প্রকৃত চেহারা বোঝার শেষ পরীক্ষা হবে ট্রাম্প কি ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা থামাতে বাধ্য করতে পারবেন কি না, তার মধ্য দিয়ে।

 

 

সেই মুহূর্তেই বোঝা যাবে—যুক্তরাষ্ট্র আসলে নিজের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, নাকি ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদী ও ধর্মান্ধ ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রকল্পকে সমর্থন করে যাচ্ছে।

 

 

এই পরীক্ষাতেই প্রমাণ হয়ে যাবে—আসলে কুকুর লেজ নাড়ে, নাকি লেজ কুকুরকে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সামি আল-আরিয়ান ইস্তাম্বুল জায়িম ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের (সিআইজিএ) পরিচালক।