কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের নীতি ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎ

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের নীতি ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎ

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন নীতির মাধ্যমে ন্যাটো জোটের দেশগুলোর জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছেন। তাঁর পূর্ববর্তী মেয়াদে ট্রাম্প একাধিকবার ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের তুলনায় অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের অভাব নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ন্যাটো সদস্যদের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা বর্তমান ২ শতাংশ লক্ষ্য থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে, বিশেষত পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে।

 


সদ্যোনির্বাচিত এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের কাঠামো পরিবর্তনের জোর দাবি জানিয়েছেন। ট্রাম্প প্রস্তাব দিয়েছেন যে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয় বহন করবে। তাঁর এই প্রস্তাব ন্যাটোর ৩২টি সদস্য দেশের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ন্যাটো, বা উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে।

 


তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ট্রাম্পের পূর্ববর্তী মেয়াদে, এই সংস্থার ভবিষ্যৎ এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ট্রাম্পের মতে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ন্যাটোর জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে, যেখানে অন্যান্য দেশ তাদের প্রতিশ্রুত ২ শতাংশ লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবার তিনি এই লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশে বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। এই নীতির মাধ্যমে ট্রাম্প মূলত একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছেন যে ন্যাটোতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক।

 

 

তাঁর মতে, ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ করলে জোট আরো শক্তিশালী হবে এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ন্যাটোর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধের ফলে ন্যাটোর আর্থিক চাপ অনেক বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বৃদ্ধি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ট্রাম্পের এই দাবি নতুন নয়, তিনি এর আগে ২০১৮ সালে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

 


অনেক সদস্য দেশ তখনো ২ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ ছিল। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুত্তেও সম্প্রতি প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য সদস্য দেশগুলোর অবদান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে রুত্তের সামঞ্জস্যতা দেখায় যে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের উভয়ের উদ্বেগ রয়েছে।

 


ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর জন্য এই প্রস্তাব একটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। বিশেষ করে ছোট এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর জন্য ৫ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করা অত্যন্ত কঠিন। এ ধরনের বৃদ্ধি তাদের সামাজিক খাত; যেমন—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক ইউরোপীয় দেশ এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লড়াই করছে।

 

 

এর মধ্যে আরো বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা তাদের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে ন্যাটোর কিছু সদস্য, বিশেষ করে পোল্যান্ড এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো, যারা রাশিয়ার হুমকি সরাসরি অনুভব করছে, এই প্রস্তাবের পক্ষে থাকতে পারে। ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের কৌশল বরাবরই আক্রমণাত্মক। তাঁর বিশ্বাস, শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো সম্ভব। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর দল ক্ষমতায় থাকলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুই হতো না, যদিও এটি একটি অনুমানমূলক বক্তব্য, তবু এটি ট্রাম্পের বৃহত্তর কূটনৈতিক কৌশলেরই অংশ।

 

 

ট্রাম্পের নীতি ও ন্যাটোর ভবিষ্যৎট্রাম্পের নতুন নীতি ন্যাটোর অভ্যন্তরে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু সদস্য রাষ্ট্র, যারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম, তারা এই নীতির পক্ষে থাকতে পারে। তবে অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধিকে বোঝা হিসেবে দেখতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে। ন্যাটো একটি যৌথ প্রতিরক্ষা সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে সব সদস্যের সমান দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত।

 

 

কিন্তু যদি অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয়, তবে এটি জোটের ঐক্যের জন্য হুমকি হতে পারে। ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং ঐক্যের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে। অনেক সদস্য দেশই তাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা বহনে অনিচ্ছুক। ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং বিভক্তির আশঙ্কা রয়েছে।

 

 

ট্রাম্পের নেতৃত্বে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তাঁর নীতি জোটের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করতে পারে, তবে এটি জোটের সংহতি ও কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের নতুন নীতির প্রভাব ন্যাটোর সামগ্রিক কর্মক্ষমতার ওপর কিভাবে পড়বে, তা সময়ই বলবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, ন্যাটোকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আরো বেশি ঐক্য এবং কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন।

 

 প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রস্তাবিত বৃদ্ধি একটি শক্তিশালী এবং সক্ষম জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। তবে এটি ন্যাটোর টেকসই অবস্থা এবং ঐক্য বজায় রাখতে কিছু চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে। বর্তমান বিশ্বে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হলে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর একটি সুসমন্বিত ও স্থিতিশীল কৌশল প্রয়োজন।

 

 

হঠাৎ করে ব্যয় বৃদ্ধি করার পরিবর্তে ন্যাটো ধাপে ধাপে ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারে, যা সদস্য দেশগুলোকে তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করবে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির জন্য ন্যাটোতে আরো বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রয়োজন। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বাইরে ন্যাটোকে সাইবার নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং কূটনৈতিক উদ্যোগের মতো বিকল্প কৌশল গ্রহণ করতে হবে। ন্যাটোর রাজনৈতিক ঐক্য সংরক্ষণে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিয়মিত সংলাপ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন, যাতে অর্থনৈতিক চাপ জোটের সংহতিকে দুর্বল না করে।

 

 

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়