কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল

এম. এ. হোসাইন [প্রকাশ: সময়ের আলো, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫]

ট্রাম্পের নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৫ সালের নভেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে যদি সংক্ষেপে একবাক্যে বলা হয়, তবে তা হবে- বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ জয় করা এবং সামরিক বিপর্যয় ঠেকানো। বাক্যটি শুনতে সহজ-সরল হলেও এর আড়ালে রয়েছে ওয়াশিংটনের চীন-দর্শনে গভীর পরিবর্তন, জোট পরিচালনায় নতুন কাঠামো এবং আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পুনর্লিখনের উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা। এই কৌশল কার্যকর হলে তা শুধু আমেরিকার এশিয়া নীতি সংশোধন করবে না; বরং অতীতের পুরোনো সব কর্মপদ্ধতি বদলে দেবে। আর সেই পরিবর্তনের অভিঘাত পড়বে শুধু যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতাতেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নাজুক ক্ষমতার ভারসাম্যেও।

 



ট্রাম্পের এই কৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে পূর্ববর্তী প্রশাসনগুলোর ওপর কঠোর সমালোচনা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে ওয়াশিংটনের ধারণা ছিল- চীনকে বৈশ্বিক বাজারে যুক্ত করলে তাকে নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করা যাবে। মুক্তবাণিজ্য, উন্মুক্ত বিনিয়োগ এবং উৎপাদন খাতের গতিশীলতা নাকি ধীরে ধীরে বেইজিংকে ঊর্ধ্বমুখী করবে। ট্রাম্পের কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে ঘটেছে এর উল্টোটা। বিশ্বায়নকে ব্যবহার করে চীন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে আরও দৃঢ় হয়েছে, আর সেই সঙ্গে ম্লান করে দিয়েছে আমেরিকার শিল্পভিত্তি, প্রযুক্তিগত প্রাধান্য ও কৌশলগত প্রভাব। ট্রাম্পের মতে, অতীতের মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের উদ্দেশ্য বুঝতে ভুল করেছিলেন, বেইজিংয়ের উচ্চাকাক্সক্ষাকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। ট্রাম্প সেই ভুল সংশোধন করেছেন- এটাই ট্রাম্পের কৌশল প্রণেতাদের দাবি।

 



এই মতাদর্শগত পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে নতুন এক প্রতিযোগিতামূলক ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল। এর সূচনা হয় একটি মৌলিক সত্য দিয়ে- এশিয়া এখন বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্র। বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় অর্ধেক উৎপন্ন হয় এই অঞ্চলে। যে রাষ্ট্র এখানে প্রযুক্তি, সামরিক সক্ষমতা ও বাণিজ্যে নেতৃত্ব দেবে, বৈশ্বিক নেতৃত্ব তার দখলেই যাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য স্পষ্ট- সে নেতৃত্ব যেন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকে, চীনের নয়।

 

 



এই পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অর্থনৈতিক পরাক্রমশীলতা। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক কাঠামোগতভাবে অন্যায্য। চীনের রাষ্ট্রনির্ভর শিল্পনীতি, ভর্তুকি, শিল্প, গোয়েন্দাগিরি সবকিছুই বৈশ্বিক বাজারকে অসম প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর মার্কিন শ্রমিকদের এর মূল্য দিতে হয়েছে উৎপাদন খাতের অবক্ষয়, বেকারত্ব, শিল্পশূন্যতার মাধ্যমে।

 


 
এই বাস্তবতা পাল্টাতে ট্রাম্পের পরিকল্পনায় চারটি প্রধান কৌশল রয়েছে। প্রথমত বাণিজ্য পুনঃসমন্বয়। পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে আমদানি-রফতানি পরিচালনা করা। চীন যে প্রবেশাধিকার পাবে, যুক্তরাষ্ট্রও পাবে ঠিক ততটাই। সংবেদনশীল শিল্প যেমন : সেমিকন্ডাক্টর, রেয়ার আর্থ, ফার্মাসিউটিক্যাল ইত্যাদি মার্কিন ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনা বা বিশ্বস্ত অংশীদারদের কাছে স্থানান্তর করা হবে। দ্বিতীয়ত চীনের আগ্রাসী বাণিজ্য আচরণ ভেঙে দেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে ভর্তুকিনির্ভর ডাম্পিং, মেধাস্বত্ব¡ চুরি এবং ফেন্টানিল প্রিসার্সর রফতানি যা আমেরিকার ওপিয়েড সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। ট্রাম্পের বক্তব্য অনুযায়ী, এগুলো কেবল অর্থনৈতিক সমস্যাই নয় বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

 



তৃতীয়ত মিত্রদের শক্তি গুণক হিসেবে ব্যবহার। মার্কিন মিত্রদের সম্মিলিত অর্থনীতি প্রায় ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলার যা মার্কিন অর্থনীতির চেয়েও বড়। এই শক্তিকে একত্র করে চীনের অতিরিক্ত প্রভাব ঠেকানো হবে। এখানে বিশেষ গুরুত্ব পাবে ভারত। আনুষ্ঠানিক মিত্র না হলেও জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

 



কোয়াডের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভারতের বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সংযোগ শক্তিশালীকরণ ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চতুর্থত সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ। ট্রাম্পের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ, পারমাণবিক আধুনিকীকরণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থায় যে দেশ আধিপত্য বিস্তার করবে, এই শতাব্দী তারই করায়ত্ত হবে। তাই এসব সেক্টরে যুক্তরাষ্ট্রকে নিঃসংকোচে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।

 



ফলে তৈরি হবে এক ধরনের ‘সুগঠিত চক্র’। অর্থনৈতিক শক্তি জোগাবে প্রতিরক্ষাকে, প্রতিরক্ষা রক্ষা করবে প্রবৃদ্ধিকে, আর উদ্ভাবন উভয়কে স্থায়ী করবে। ট্রাম্পের ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য নয়; বরং যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য। আর তা সম্ভব হবে প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতায় অপ্রতিরোধ্য প্রাধান্য ধরে রাখার মাধ্যমে।

 



এই প্রেক্ষাপটে তাইওয়ান, সেমিকন্ডাক্টর আধিপত্য ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এখানে সংঘাত ঘটলে বৈশ্বিক নৌ-বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ বিপন্ন হবে। ট্রাম্পের কৌশলে দীর্ঘ দিনের মার্কিন নীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে চায় না, তবে প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে চায়। এর জন্য আরও অস্ত্র,  প্রশিক্ষণ, সমুদ্র-সহযোগিতা এবং প্রথম দ্বীপমালায় মিত্রদের সঙ্গে গভীর সমন্বয় বৃদ্ধি করার পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়েছে। 

 



জাপান থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রথম দ্বীপমালা যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা-রেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় এই অঞ্চলের যেকোনো অংশে চীনা আগ্রাসন হলে যুক্তরাষ্ট্র যেন তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এর সঙ্গে একটি শর্তও আছে, এই বোঝা একা বহন করবে না আমেরিকা। এর জন্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়াকে আরও ব্যয়, সক্ষমতা ও সামরিক প্রবেশাধিকারের জন্য চাপ দেওয়া হবে।

 



দক্ষিণ চীনসাগর প্রভাব বিস্তারের আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র। বেইজিংয়ের কৃত্রিম দ্বীপগুলোর সামরিকীকরণ এবং এর বিস্তৃত সামুদ্রিক দাবিকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর কার্যত শুল্ক আরোপের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। ট্রাম্প প্রশাসন টহল তীব্রতর করবে, যৌথ নৌ-মহড়া সম্প্রসারিত করবে এবং সমুদ্রপথগুলো উন্মুক্ত ও করমুক্ত রাখতে ভারত ও জাপানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।

 



সংক্ষেপে, প্রতিরোধ কৌশলটি সরল : পর্যাপ্ত শক্তি প্রদর্শন করে বেইজিংকে বোঝানো যে সামরিক দুঃসাহসিকতা নিষ্ফল। এবার আসি দক্ষিণ এশিয়া। দীর্ঘদিন ধরে অঞ্চলটি মার্কিন নীতির প্রান্তিক জায়গা ছিল। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সেটি বদলে যায়, এটি হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় থিয়েটার।

 



পাকিস্তানের জন্য চিত্রটি উদ্বেগজনক। চীনের সঙ্গে এর গভীরতর সম্পর্ক, বিশেষত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) মাধ্যমে, ইসলামাবাদকে প্রতিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দিয়েছে। ট্রাম্পের একটি কৌশল হলো চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য দুর্বল করা। সাহায্যের শর্তারোপ, সন্ত্রাসবাদ দমনের দাবি এবং চীনা প্রকল্পগুলোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তা অনিবার্যভাবে ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

 



বাংলাদেশের অবস্থান আরও সূক্ষ্ম। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য, পশ্চিমা বাজারে প্রবেশাধিকার, জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এগুলো নতুন সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু চীনা অবকাঠামোনির্ভরতা কৌশলগত প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ঢাকাকে আরও স্পষ্ট অবস্থান নিতে চাপ দেবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

 



শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ- যেখানে চীন-ভারত প্রভাব প্রতিযোগিতা আগে থেকেই রয়েছে, সেখানে এই চাপ আরও বাড়বে। বন্দর, টেলিকম, ঋণনির্ভর প্রকল্প- সবই নতুন ভূরাজনৈতিক মাপকাঠিতে পুনর্বিবেচিত হবে। ভারত মহাসাগর আর শান্ত পটভূমি থাকবে না; সক্রিয় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।

 



সাম্প্রতিক এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রকে আরও লেনদেনমুখী, আরও শক্তিনির্ভর ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি গ্রহণের দিকে ঠেলে দেবে। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ বাড়বে, প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতা ত্বরান্বিত হবে, জোট-নেটওয়ার্ক ঘনিষ্ঠ হবে, আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে কৌশলগত অবস্থান স্পষ্ট করতে বাধ্য করা হবে। কেউ মানিয়ে নেবে, কেউ প্রতিরোধ করবে, কিন্তু সবাই চাপ অনুভব করবে।

 



ট্রাম্পের এই নিরাপত্তা পরিকল্পনা একটি বাজির ওপর নির্মিত : যেখানে অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত আধিপত্য এবং একটি সুসজ্জিত জোট যুদ্ধ ছাড়াই শান্তি রক্ষা করতে পারে। প্রশ্ন শুধু একটাই-এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, এই ঝড়ো প্রতিযোগিতার অভিঘাত সামলে উঠতে পারবে তো? নাকি আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়বে এমন এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যার শেষ এখনও দৃষ্টিসীমায় নেই।