কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের নতুন জামানা ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ

ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম দিকটি হতে পারে, পশ্চিম গোলার্ধে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামা খালের প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে শিরোনামে স্থান পেয়েছে। আগামী দিনগুলোতে কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তাই দেখার বিষয় ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় দিকটি হতে পারে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সম্পৃক্ততা কমানো ইউক্রেন যুদ্ধের চুক্তির বিষয়টিও ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে* যুক্তরাষ্ট্র আর এককভাবে ন্যাটোতে বেশি অর্থ ব্যয় করবে না তেহরানকে দমিয়ে রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়বে মার্কিন মিত্রদের একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় জোটের ওপর- স্টেফান উলফ । সূত্র : ইত্তেফাক, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের নতুন জামানা ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ

হোয়াইট হাউজে ফিরছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে তার এভাবে ফিরে আসার ঘটনাকে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। নতুন ট্রাম্প জামানায় মার্কিন কূটনীতির ধরনও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

 


বিদেশি নেতাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকিধমকি ও শক্ত কথাবার্তা গাজায় শান্তিচুক্তি আনতে সাহায্য করেছে। চুক্তিটি কিছুটা নড়বড়ে বটে, তবে তা জো বাইডেন ও তার প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় এবং আলাপ-আলোচনা করেই সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত ৭ জানুয়ারি ট্রাম্পের ‘যদি বন্দীদের মুক্তি না দেওয়া হয়, তাহলে নরককা– ঘটে যাবে’—এমন মন্তব্যের পরেই মূলত পরিস্থিতি পালটে যেতে শুরু করে। ঐ হুঙ্কারের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্¿ী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের তাগাদা অনুভব করেন। অর্থাত্, সংঘাত বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার ওপর একধরনের চাপ ছিল। ফলে ইসরায়েল সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। 

 

 


ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদেও এই ধরনের কঠিন ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ড কেনা, কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং পানামা খাল পুনর্দখল করার হুমকি দিয়ে তিনি আবারও দেখিয়েছেন যে, সামনের দিনে এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এটা অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মিত্রদের জন্য খুব একটা ভালো সংবাদ নয়। 

 

 

ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা হিসেবে ইলন মাস্কের নাম এখন সারা বিশ্বের মানুষ জানে। মাস্ক গর্বসহকারে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করার কথা বলেছেন প্রকাশ্যে। তার এ কথার মাধ্যমে স্পষ্টত ‘একটি বিশ্বব্যাপী জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জোট’ গড়ার প্রচেষ্টার বিষয়টি সামনে এসে পড়ছে। 

 

 


রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করতে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চুক্তি, ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কৌশল পুনরুজ্জীবিত করা এবং চীনের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার প্রতিজ্ঞাসহ ট্রাম্প যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাতে মৌলিক পররাষ্ট্রনীতির পুনর্গঠনের সমস্ত উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কারণে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ‘একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু’ দেখছেন বিশ্লেষকরা।

 

 

এক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম দিকটি হতে পারে, পশ্চিম গোলার্ধে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা, তথা এই অঞ্চলের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা এবং কৌশলগত দুর্বলতা দূর করার প্রশ্নে বিশেষত এই অঞ্চলে ট্রাম্পের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিষয়কে একপ্রকার নিশ্চিত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামা খালের প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে শিরোনামে স্থান পেয়েছে। আগামী দিনগুলোতে কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তাই দেখার  বিষয়।

 

 

গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামা খালের বিষয়ে চীনের ভূমিকা কী হতে পারে, সে সম্পর্কে ট্রাম্প কিছুটা অতিরঞ্জিত দাবি করেছেন বটে। তবে এ কথা সত্য যে, লাতিন আমেরিকায় উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে বেইজিং। বিশেষত, অর্থনৈতিক খাতে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা এখন আর অগোচরে নেই। পেরুতে চীনের অর্থায়নে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হয়েছে। এধরনের প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

 

 

মেক্সিকোতেও বিনিয়োগ করেছে দেশটি। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেইজিংয়ের জন্য ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার’ তৈরি হয়েছে, যা ওয়াশিংটনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। কেননা, মেক্সিকো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকোর রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছরটিতে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ছিল ৪০১ বিলিয়ন ডলারের।

 

 

পশ্চিম গোলার্ধে চাপ বাড়ানোর জন্য ট্রাম্প সম্ভবত হুমকিমূলক বক্তব্য, শুল্ক এবং রাজনৈতিক চাপ প্রদানের মতো পদক্ষেপ নিতে পারেন। এসব বিষয় নতুন প্রশাসনের নজরে আনার জন্য ট্রাম্পের মিত্ররা ইতিমধ্যেই মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে একটি বিলও উপস্থাপন করেছেন। ঐ বিলে ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আলোচনার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

 

 

ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় দিকটি হতে পারে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সম্পৃক্ততা কমানো। ধারণা করা হচ্ছে, যেসব অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র ‘দ্বিতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করে, সেখানে নিজেদের সম্পৃক্ততা কমানোর পরিকল্পনা করবে ট্রাম্প প্রশাসন। আর এক্ষেত্রে তারা বেছে নিতে পারে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল। 

 

ইউক্রেন যুদ্ধের চুক্তির বিষয়টিও ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি ট্রাম্পের মুখ থেকে একাধিকবার শোনা গেছে। ফলে এটা তার প্রশাসনের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে। এই ইস্যু সমাধানের মাধ্যমে তিনি রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কের একীভূততা দুর্বল করতে চাইবেন স্বাভাবিকভাবেই। 

 

 

এর পাশাপাশি ন্যাটো মিত্রদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে ট্রাম্পের জোরালো দাবি ইঙ্গিত দেয় যে, নতুন প্রশাসন ট্রান্সআটলান্টিক নিরাপত্তাকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আর এককভাবে ন্যাটোতে বেশি অর্থ ব্যয় করবে না। কারণ ট্রাম্প যুক্তি তুলে ধরে বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ন্যাটোর মোট ব্যয়ের ৬৮ শতাংশই বহন করে, যেখানে ইউরোপীয় সদস্যরা সবাই মিলে জোগান দেয় মাত্র ২৮ শতাংশের।

 

 

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন প্রশাসনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে—এ কথা স্বভাবতই অনুমেয়। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে হামাসের হাতে আটকে থাকা ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির পথ সহজতর হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে একটি দিশা তৈরি হয়েছে। যদিও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ইসরায়েলের সম্মতির ওপরেই ঝুলে থাকবে। তবে একবার জুতসই চুক্তি কার্যকর হয়ে গেলেই তা হবে আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক উন্নত করার একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক। সে অবস্থায় ইরানকে আর চোখে চোখে রাখার দরকার পড়বে না ওয়াশিংটনের। বরং তেহরানকে দমিয়ে রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়বে মার্কিন মিত্রদের একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় জোটের ওপর।

 

 

পশ্চিম গোলার্ধ, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হলেও চীনের বিষয়ে তিনি ঠিক কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তার জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বেইজিংয়ের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করবেন বলেই ধরে নিতে হবে। অবশ্য ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে বেইজিংয়ের প্রতি ইলন মাস্কের সুর নরম থাকতে দেখা যেতে পারে।

 

 

মজার বিষয় হলো, একদিকে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা, অন্যদিকে সমঝোতামূলক বক্তব্যের কারণে খোদ নিজেই দোদুল্যমান ট্রাম্প! ট্রাম্প মনে করেন, পানামা খালের ওপর চীনের নিয়ন্¿ণ রয়েছে। আর তাই কৌশলগত বাণিজ্যিক রুটটিকে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে নেওয়া প্রয়োজন। আবার, ইউক্রেন চুক্তির ক্ষেত্রে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সহযোগিতা বিশেষ কাজ করবে বলে তার ধারণা। সম্ভবত এজন্য নিজের অভিষেকে শিকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন।  

 

 

ট্রাম্পের এই ‘বহুমুখী কৌশল’ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন বয়ে আনে, তাই দেখার বিষয়। ধারণা করা যায়, চীনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে ট্রাম্প সবসময় খোলামেলা থাকতে পারেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চীনেরও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আগ্রহ রয়েছে।

 

 

নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তার সমর্থকদের বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি সেসব বাস্তবায়নে জোর চেষ্টা চালাবেন। যদিও রিপাবলিকান সমর্থকরা তাকে সম্ভবত ‘একজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি’ হিসাবে দেখতেই বেশি পছন্দ করবেন! ফলে নতুন ট্রাম্প জামানায় বিশ্ব কতটা স্থিতিশীল থাকবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর সেই অস্থিতিশীল পৃথিবীতে ‘একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ কীভাবে এবং কাদের হাত ধরে গড়ে উঠবে, তার দিকেই দৃষ্টি সারা বিশ্বের মানুষের। 

 

 

লেখক : বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অধ্যাপক

দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন