ট্রাম্পের পরিকল্পনা এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন শঙ্কা
ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দায়িত্ব গ্রহণের পরই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত দিনকার ইসরায়েলপ্রীতির নতুন প্রকাশ ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর নেতানিয়াহুই প্রথম রাষ্ট্রনেতা, যাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক গত বছর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের অতিথি হিসেবে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কর্তৃত্বকে কার্যত প্রত্যাখ্যান করলেন ট্রাম্প।
এ কথাও ঠিক যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, এর পেছনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা রয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারির প্রতি এক ধরনের ভীতির কারণে হামাস তড়িঘড়ি ইসরায়েলের সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। বরং এটিই সত্যি যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েলের আপত্তি এবং গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় কোনো গতি সঞ্চার করতে পারেনি। মজার বিষয় হলো, এত দিন ধরে চলে আসা আলোচনাপ্রক্রিয়াটি গুরুত্ব পেয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিপ্রায় অনুসারে এবং ইসরায়েল তড়িঘড়ি করে ট্রাম্পের অভিষেকের ঠিক আগে হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্পের গাজানীতি যেন ইসরায়েলের অভিপ্রায়কেই প্রতিনিধিত্ব করছে, যার অর্থ দাঁড়ায় দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে গাজা নিয়ে তিনি একটি বোঝাপড়ায় উপনীত হয়েছিলেন। এর প্রমাণ মিলতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। তিনি গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিতে এবং গাজা খালি করতে এরই মধ্যে জর্দান ও মিসরের সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, দেশ দুটির জন্য অতীতে যুক্তরাষ্ট্র অনেকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তিনি আসা করবেন, তারাও এবার গাজার মানুষের জন্য কিছু করবে।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর লাখ লাখ গাজাবাসী জর্দান, মিসর এবং অন্যান্য আরব দেশে আশ্রয় নিয়েছে। জর্দানে এরই মধ্যে ২০ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছে, যারা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের বেশির ভাগকেই দেশটি নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। আমরা জানি, গাজায় বসবাস করা মোট অধিবাসীর সংখ্যা ২৩ লাখ। এর একটি বড় অংশ, ধারণা করা যায় ১০ লক্ষাধিক বর্তমানে গাজার বাইরে মিসর, জর্দানসহ অপরাপর দেশগুলোতে বসবাস করছে।
তাদের ফিরতে বাধা দেওয়া বা অপর দেশগুলোতে তাদের বসবাস করতে বাধ্য করতে পারলে স্বল্পসংখ্যক অধিবাসীসংবলিত গাজায় সহজেই ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনকে উৎসাহ দেওয়া যাবে। এটিই ট্রাম্পের পরিকল্পনা কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ এভাবেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের মন জোগাতে তৎপরতা চালাতে চান কি না, সেটিও ভাবনার বিষয়।
গাজা খালি করতে ট্রাম্পের এই আহ্বান সাময়িক, নাকি স্থায়ী—এ বিষয়ে ট্রাম্প কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে ট্রাম্পের এই আহ্বানকে সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে জর্দান ও মিসর। বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের তরফ থেকে ট্রাম্পকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে গাজায় অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারীদের সেখানে পাকাপোক্তভাবে বসবাস করার প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে জর্দান, মিসর ও অপরাপর আরব দেশগুলোতে সাময়িকভাবে বা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণকারীদের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর হামাসের পক্ষ থেকে যখন বাস্তুচ্যুত মানুষকে সেখানে ফিরিয়ে নেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে, এই অবস্থায় ট্রাম্পের এ ধরনের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী এবং এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে বলে ধারণা করছেন আরব নেতারাও। তাঁদের মতে, যদি গাজার পুনর্গঠনের প্রয়োজনেও ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এ ধরনের আহ্বান জানানো হয়, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। গাজা খালি করে, সেখানকার মানুষকে অন্যত্র রেখে কোনো ধরনের পুনর্গঠন যথার্থ নয় বলে মন্তব্য তাঁদের। বাস্তবিক অর্থে এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের অন্য রকম উদ্দেশ্যর ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন সবাই। আর সে জন্যই এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা।
এদিকে বাইডেনের পক্ষ থেকে স্থগিত করা ইসরায়েলকে দুই হাজার পাউন্ডের বোমা সরবরাহের সিদ্ধান্তটি ক্ষমতার চেয়ারে আরোহণ করেই প্রত্যাহার করেছেন ট্রাম্প। ইসরায়েল যুদ্ধে এবং বেসামরিক মানুষ নিধনে এই বোমার ব্যবহার করতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে বাইডেন এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্তে জানিয়েছেন হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহসহ ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাত থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। এর মধ্য দিয়ে মূলত ট্রাম্প ইসরায়েলকে নতুন করে শক্তির জোগান দিতে যাচ্ছেন এবং অদূরভবিষ্যতে এই যুদ্ধকে আরো উসকে দিতে চাচ্ছেন বলে ধারণা করা যায়।
পাশাপাশি যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার স্থায়িত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে যাচ্ছে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তসহ গাজা খালি করার বিষয় নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক চিন্তা-ভাবনা। এক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে, যা নিয়ে ইসরায়েল সব সময় বিরোধিতা করেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই ইসরায়েলের প্রতি ইতিবাচক থাকলেও দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধান করতে গিয়ে বরাবরই ইসরায়েলের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। আবার হামাসের পক্ষ থেকে যখন এর অংশ হিসেবে ইসরায়েলের প্রতি ক্ষুব্ধ আচরণ করা হয় এবং এর বিপরীতে ইসরায়েল পৈশাচিক শক্তি প্রয়োগের মতো ঘটনা ঘটায়, যুক্তরাষ্ট্রকে তখন সব কিছু ভুলে তার ‘ইসরায়েল প্রথম’ নীতি প্রয়োগ করতেই দেখা যায়।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি যদি তাঁর এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি, স্বাক্ষরিত হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি অচিরেই ভণ্ডুল হতে যাচ্ছে। এর আগে আমরা মার্কিন প্রশাসনকে দেখেছি, তারা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এলেও কখনো গাজা খালি করার মতো সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি এবং এ ধরনের উদ্যোগ নেয়নি, বরং তারা বারবার এটিই বলে আসছে যে তারা পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতিকে সমর্থন করে না। ২০২৩ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছিলেন, ‘তারা (ইসরায়েল) গাজা ছাড়তে বাধ্য করতে পারে না এবং তা উচিতও নয়।’
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় সামনে এসেছে, যখন ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করছে—এই মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে এবং এর ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষকে গাজায় ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হচ্ছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কেবল আরব রাষ্ট্রগুলোই নয়, এর বিরোধিতা করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররাও। এরই মধ্যে জার্মানির তরফ থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, কোনো ধরনের পুনর্বাসন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বা অন্য কোনো কারণে গাজার অধিবাসীদের অন্যত্র বসবাস করার বিষয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয়।
এই পরিকল্পনাকে ভয়াবহ বলে জানিয়েছে আরব লীগ। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষকে ফিরতে না দেওয়ার ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে জাতিগত নিধনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কোনো কিছু খোলাসা না করলেও ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে আলোচনা করে ভিন্ন অবস্থানে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে চাই। এতে হয়তো তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। তারা হয়তো শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বিষয়টি আসলে পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি এসব ফিলিস্তিনিকে আর গাজায় ফিরতে দিতে চান না, সে ক্ষেত্রে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধান থেকে নিশ্চিতভাবেই তিনি অনেক দূরে অবস্থান করছেন। আর এমনটি হলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এটি একটি বড় ধরনের পরিবর্তন।
আগেই উল্লেখ করেছি, ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগের দিন যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়া মানে গাজা নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর গোপন সমঝোতা বাস্তবায়ন। এর প্রতিফলন ঘটেছে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ নিয়ে তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায়। এই চুক্তি নিয়ে তিনি খুব একটা আশাবাদী নন বলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তাহলে কেন তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন? এর জবাব হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি ইসরায়েলকে এটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তারা এটি করলে ভবিষ্যতে তিনি তাদের চাওয়া বাস্তবায়নে কাজ করতে পারবেন। তাই তাঁর সুপ্ত ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে সময় নেননি তিনি। আইসিসি কর্তৃক নেতানিয়াহুর প্রতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকেও তোয়াক্কা করছেন না তিনি। তাঁকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দুই কট্টর নেতার মধ্যে আসন্ন বৈঠকটি নতুন কোনো অনিশ্চয়তার জন্ম দেয় কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়