কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের শান্তি ভাবনা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ

ড. সুজিত কুমার দত্ত [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫]

ট্রাম্পের শান্তি ভাবনা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে সাম্প্রতিক শান্তি উদ্যোগ ইউরোপজুড়ে অভূতপূর্ব উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ওয়াশিংটন-মস্কো গোপন সমঝোতার সম্ভাবনা এমন এক সময় সামনে এসেছে, যখন ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো রাশিয়ার আগ্রাসনকে মহাদেশের প্রধান নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছে। ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পর যখন ইউরোপ আশা করছিল, তাদের নিরাপত্তা অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ন্যাটোকাঠামোকে ওয়াশিংটন আরো শক্তিশালী করবে, তখন ট্রাম্পের বিকল্প শান্তি ফর্মুলা মূলত রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক লাভকে স্থায়ী করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

 

 

ইউরোপীয় সরকারগুলো মনে করছে, দ্রুত করা যেকোনো যুদ্ধবিরতি বা শান্তিচুক্তি রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলোতে কোনো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না, বরং মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে নতুন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চুক্তির পথ খুলে দিতে পারে।

 

 


এটি বাস্তবায়িত হলে ইউরোপকে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করতে হবে এক নতুন ‘ওয়াশিংটন-মস্কো অক্ষ’, যা ইউরোপের কৌশলগত অবস্থানকে আরো দুর্বল করবে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা আশঙ্কা করছেন, এটি শুধু ন্যাটোর সমষ্টিগত নিরাপত্তা সিদ্ধান্তকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং ইউরোপকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আবারও আমেরিকানির্ভরতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, যাকে তাঁরা রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে সবচেয়ে ভীতিকর সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন।

 

 


ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অবস্থান ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামোতে গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। ব্রাসেলসে ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাম্প্রতিক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের আসন খালি থাকা ছিল এক প্রতীকী সতর্কবার্তা।

 


বিশেষ করে এমন সময়ে যখন ট্রান্সআটলান্টিক ঐক্য নতুন করে যাচাইয়ের মুখে।
দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বয়কট করলেন, যা দেখায় যে প্রতিষ্ঠিত নিরাপত্তা জোটের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন আর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। কিন্তু এই নাটকের আসল রূপায়ণ ঘটছে ব্রাসেলসে নয়, বরং মস্কোতে। ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কুশনার প্রায় পাঁচ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে, যেখানে হাতবদল হয় চারটি গোপন নথি।

 

 


ইউরোপীয় নেতারা যখন ব্রাসেলসে অপেক্ষা করছিলেন, তখন ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে মূল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল তাঁদের বাইরে রেখে—একান্তভাবে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে। এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্পের তথাকথিত ‘শান্তি ভাবনা’ মূলত এক ধরনের শক্তির পুনর্বিন্যাস, যার উদ্দেশ্য ইউরোপকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

 


ইউরোপের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাটোর ১৯৪৯ সালের সমষ্টিগত সিদ্ধান্তকাঠামো কার্যত ‘ডি-ফ্যাক্টো পতনের’ মুখে। নতুন যে হায়ারার্কি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা ইউরোপের জন্য সতর্কবার্তা : ট্র্যাক ওয়ানে ওয়াশিংটন ও মস্কো সিদ্ধান্ত নেবে; ট্র্যাক টুতে কিয়েভ কেবল নোটিশ পাবে; আর ট্র্যাক থ্রিতে ইউরোপ পরে জানতে পারবে কী নির্ধারিত হয়েছে। এই অদ্ভুত শক্তির বিন্যাস ইউরোপীয় নিরাপত্তানীতি ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা দুইকেই নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।

 

 


ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব যেন স্থায়ী শান্তির চেয়ে বেশি—এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক দর-কষাকষির ফল, যেখানে মিত্রদের ওপর আস্থা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ফলে ইউরোপ এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে ট্রাম্পের ‘ডিল-মেকিং’ কূটনীতি, অন্যদিকে রাশিয়ার আগ্রাসী কৌশল—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অনিশ্চয়তাই ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

 


ফাঁস হওয়া ২৮ দফার শান্তি প্রস্তাব এমনভাবে রচিত যে মনে হয়, রাশিয়ার অনেক মৌলিক দাবি মাথায় রেখেই সমঝোতার কাঠামো গড়া হয়েছে। মার্কিন সিনেটর মাইক রাউন্ডস নিজে স্বীকার করেছেন রুবিও এই প্রস্তাবকে রাশিয়ার ‘উইশ লিস্ট’ বলেই উল্লেখ করেছেন। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাল্টা প্রস্তাব কিছু ঘণ্টার মধ্যেই ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করে বাতিল করে দিয়েছে ওয়াশিংটন।

 

 

ইউরোপকে যেন স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হলো, শান্তিপ্রক্রিয়ায় তোমাদের সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা আর নেই। বাস্তবতা হলো, ন্যাটোর সামরিক ব্যবস্থা এখনো আমেরিকান অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ। প্রতিরক্ষা বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। স্ট্র্যাটেজিক ইন্টেলিজেন্স, স্যাটেলাইট নজরদারি, মিসাইল ডিফেন্স—এসবই শতভাগ ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণে। ফলে মার্কিন সহায়তা ছাড়া ইউরোপীয় বাহিনী কার্যত পঙ্গু। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির হতাশা গভীর বাস্তবতাকে তুলে ধরে—অপমান অথবা সঙ্গী হারানো এই দুইয়ের মাঝে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ বন্দি হয়ে গেছে।

 

 

ইউরোপের নিরাপত্তা শঙ্কার মূল কারণ শুধু রাশিয়ার অগ্রাসন নয়, বরং ওয়াশিংটনের নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বোঝা বাড়ায় এবং ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে পুনরায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন নতুন একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে, যা ইউরোপের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো জানে, রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা তাদের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

 

 

শান্তি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু যে শান্তি ইউরোপের সম্মিলিত নিরাপত্তাকে দুর্বল করে, ন্যাটোর স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, রাশিয়ার আগ্রাসনকে পুরস্কৃত করে এবং ইউক্রেনকে একপ্রকার চাপের মুখে ঠেলে দেয়, সেটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নয়, এটি এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক সমঝোতা। এই সমঝোতা যদি কার্যকর হয়, তবে তা ১৯৪৫-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে মূলত নতুনভাবে লিখবে। কিন্তু সেই লেখা হবে ব্রাসেলস বা কিয়েভে নয়, হবে মস্কো ও ওয়াশিংটনে।

 

 

আজ ন্যাটোর মন্ত্রীরা ব্রাসেলসের বৈঠককক্ষে বসে রয়েছেন শুধু একটি ফোনকলের অপেক্ষায়, যেখানে তাঁদের জানানো হবে শান্তির মূল্য কত। এই অস্থিরতা, এই অনিশ্চয়তা এবং এই নিরাপত্তার ধাক্কাই ইউরোপের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা। ইউরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা ভেঙে পড়ছে; ইউরোপের নিরাপত্তানীতি এখন আর নিজেদের হাতে নেই। ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তি যদি ন্যাটোর বাইরে দুই সুপারপাওয়ারের হাতে নির্ধারিত হয়, তবে ইউরোপকে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করতে হবে, যেখানে তাদের কণ্ঠস্বর সবচেয়ে দুর্বল, কিন্তু ঝুঁকি সবচেয়ে বড়।

 

 

এ কারণেই ট্রাম্পের শান্তি ভাবনা ইউরোপে শান্তির বার্তা নয়, বরং এক নতুন নিরাপত্তা সংকটের ইঙ্গিত, যা আগামী দশকের ভূ-রাজনীতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়