কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের শপথ, শুল্ক প্রসঙ্গ এবং উৎসুক বিশ্ববাসী

নিরঞ্জন রায় । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের শপথ, শুল্ক প্রসঙ্গ এবং উৎসুক বিশ্ববাসী

২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, বিশ্বজুড়েই যেন উৎসুক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে দেশটির ভেতরে এবং বিশ্বব্যাপী এক ধরনের আগ্রহ থাকে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন অলিখিত বিশ্বনেতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যত না যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। সে নেতৃত্ব কেমন হবে, তা ভিন্ন আলোচনা।

 

 

তবে নেতৃত্ব যেমনই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়ে আগ্রহ থাকবেই। এবার অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে আগ্রহের মাত্রাটা যেন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কারণ, নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই, অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচারের শুরু এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে ট্রাম্প ক্রমাগত বিশ্বসংবাদ হওয়ার মতো বক্তব্য দিয়ে চলেছেন একের পর এক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কথা বলেন কম, কিন্তু কাজ করেন বেশি। ট্রাম্পের ব্যাপারে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। তিনি বলেন বেশি, কিন্তু বাস্তবে করবেন কতটুকু, তা দেখার জন্য আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

 

 

এবারের শপথ অনুষ্ঠান যেমন ট্রাম্পের নিজের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমন তার সমর্থকদের মধ্যেও ছিল স্মরণীয় মুহূর্ত। সাধারণ সমর্থকরা এ শপথ অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন সশরীরে উপস্থিত থেকে এবং ভার্চুয়ালি প্রত্যক্ষ করে। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে যারা পরিচিত, তারা তো নিজেদের আনন্দের উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারেননি এবং আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে কেউ কেউ তা প্রকাশও করে ফেলেছেন। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি ইলন মাস্কের উচ্ছ্বাস প্রকাশ সে রকমই ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানের স্টেজে উঠে ইলন মাস্ক যেভাবে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তেমনটা আগে কখনও কেউ করেছেন কি না, সন্দেহ।

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মতো জয়লাভ ইতিহাস হয়েই থাকবে অনেক কারণে। গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের মেয়াদ শেষে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, সমগ্র বিশ্বকেই হতবাক করেছিল। বিশেষ করে ট্রাম্পের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা এবং তার কিছু সমর্থকের ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করার মতো ঘটনার পর ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচন করে এত ব্যাপক বিজয় অর্জন করবেন, তেমনটা অনেকের কল্পনার মধ্যেও ছিল না।

 

 

শুধু তাই নয়, তার সামনে চ্যালেঞ্জের অন্ত ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে গোপন যোগাযোগের অভিযোগের তির সব সময়ই তার দিকে তাক করা ছিল। গত মেয়াদে তাকে দুবার অভিশংসন করার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে। ফেডারেল এবং স্টেটের আদালতে একাধিক মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি এবং জেলে পাঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। সর্বশেষ তার জীবননাশের চেষ্টাও হয়েছে দুবার, যেখান থেকে তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন।

 

 

এতসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আর কোনো প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে এভাবে জয়লাভ করেছেন কি না, আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প সেই নজির স্থাপন করতে পেরেছেন এবং সঙ্গত কারণেই তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান স্মরণীয় হয়েই থাকবে।

 

 

এ শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে বিশ্বনেতাদের উৎসুক দৃষ্টি থাকার অন্যতম কারণ ছিল, প্রথম দিনে ট্রাম্প কী ধরনের নির্বাহী আদেশ জারি করেন। আগের কয়েক প্রেসিডেন্টের মতো ট্রাম্পও প্রথম কার্যদিবসেই যে কিছু নির্বাহী আদেশ জারি করবেন তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কোন কোন আদেশ প্রথম দিনেই স্বাক্ষর করবেন তা নিয়েই বেশি জল্পনাকল্পনা ছিল। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে যে কয়েকটি বিষয় সামনে এনেছেন তার মধ্যে উচ্চহারে শুল্ক ধার্য এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

 

 

ট্রাম্প আগে থেকেই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীন থেকে আমদানি পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৬০% শুল্ক ধার্য করবেন এবং কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ২৫% হারে শুল্ক আরোপ করবেন। এ উচ্চহারের শুল্ক ধার্যের ঘোষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং এখনও চালু আছে।

 

 

সবার বদ্ধমূল ধারণা ছিল ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে প্রথম দিনেই যেসব নির্বাহী আদেশ জারি করবেন তার প্রথমেই থাকবে এ উচ্চহারের শুল্ক ধার্যের বিষয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তিনি দুই ডজনের বেশি নির্বাহী আদেশ জারি করলেও তার মধ্যে উচ্চহারের শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে একটিও নেই। এ ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কানাডা এবং মেক্সিকোর আমদানির ওপর ২৫% হারে শুল্ক আরোপের কথা বিবেচনায় রেখেছেন।

 

 

আর চীন এবং অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে যাচাইবাছাই ও বিশ্লেষণ করে দেখতে বলেছেন। আসলে উচ্চহারে শুল্ক ধার্যের বিষয়টি অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাই এ বিষয়ে বলা যত সহজ, বাস্তবে প্রয়োগ করা ততই কঠিন। বিষয়টি ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিধায় এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই।

 

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিবাচিত হওয়ার পর থেকেই উচ্চহারে শুল্ক আরোপের বিষয় ছাড়া আরও একটি বিষয় বিশ্বনেতাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। তা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান যুদ্ধ বন্ধ হবে কি না। কেননা ট্রাম্প বরাবরই জোর দিয়ে বলে আসছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধ বাধতে দিতেন না।

 

 

এমনকি তিনি এও উল্লেখ করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দুই দিনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যেগ নেবেন। এ কারণেই বিশ্বনেতাদের আগ্রহ ছিল যে শপথ গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে তার করণীয় তুলে ধরবেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি এ প্রসঙ্গে সে রকম স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। অবশ্য এমনটা বাস্তবসম্মতও নয়। কেননা এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো পক্ষ নয় যে তিনি ঘোষণা দিলেই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে।

 

 

তবে যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে সে রকম কোনো ঘোষণা বা বক্তব্য না দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকেই যুদ্ধের উত্তেজনা বেশ কমে গেছে। ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধাবসানের পথেই অগ্রসর হতে চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সেই টানটান উত্তেজনা নেই। এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প যে ইউক্রেনকে অর্থের জোগান দেবেন না তা খুব সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাশিয়ার ওপরও চাপ অব্যাহত থাকবে। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া সময়ের ব্যাপার। চীন-তাইওয়ান উত্তেজনাও থেমে গেছে।

 

 

বড় বড় যুদ্ধের পাশাপাশি কিছু আঞ্চলিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল বলে জোর আলোচনা আছে। সেসব বিষয়ও আর সেভাবে গুরুত্ব পাবে না বলেই পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। কেননা ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ম্যাক্রো লেভেল বা বৃহত্তর প্রেক্ষাপট চিন্তা করেন। মাইক্রো লেভেলে গিয়ে বা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে চিন্তা করার মতো মানুষ তিনি নন। অথচ এসব কাজে ডেমোক্র্যাটরা খুবই পারদর্শী।

 

 

ফলে যেসব ছোট ছোট দেশ এবং অঞ্চল এসব সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে আসছিল, তারা কিছুটা হলেও বেকায়দায় পড়তে পারে। মোট কথা বাইডেন সরকারের আমলে বিশ্বে যে এক ধরনের যুদ্ধের দামামা চলছিল, তা আপাতত বন্ধ হতে চলেছে বলেই ধারণা করা যায়। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসাবান্ধব এবং কোনোভাবেই যুদ্ধের পক্ষে নন, যার স্বাক্ষর তিনি গত মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রেখেছেন। তাই আশা করা যায়, আগামী চার বছর বিশ্ব যুদ্ধ থেকে দূরে থাকবে, যদি পানামা ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণ এবং ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নেওয়ার হুমকি কথার কথা হয়ে থাকে।

 

 

আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ এবং প্রথম দিনেই নির্বাহী আদেশ জারি নেহাতই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ থেকে কোনো কিছুই আঁচ করা যাবে না যে আগামীতে বিশ্বরাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাস্তবে কীভাবে ভূমিকা রাখেন তার ওপর নির্ভর করবে আগামীতে বিশ্বরাজনীতির ধরন কেমন হবে। তবে শপথ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কর্মতৎপরতা দেখে এটা অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেছে যে তিনি আগের মেয়াদের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞ, পরিপক্ব এবং তার করণীয় সম্পর্কে খুব বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ।

 

 

তা ছাড়া ব্যক্তি ট্রাম্পকে আগে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। তিনি কখন কী বলবেন বা সিদ্ধান্ত নেবেন তা কোনোভাবেই আঁচ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বনেতৃত্ব কিছুটা হলেও এক ধরনের চাপের মধ্যেই থাকবেন। তবে বাস্তবে প্রেসিডেন্ট যা-ই করুন না কেন, আগামী চার বছর তিনি যে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখবেন এবং সেই সঙ্গে মিডিয়ায় সরব থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার টরন্টো, কানাডা