কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক নীতি কতটা বাস্তবসম্মত

নিরঞ্জন রায় । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক নীতি কতটা বাস্তবসম্মত

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়া পর্যন্ত, পুরোটা সময় ধরে উচ্চশুল্কের বিষয় নিয়েই ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সেই শুল্ক আলোচনা নতুন গতি পেয়েছে। ট্রাম্পের উচ্চহারে শুল্ক ধার্যের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যত আলোচনা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ কানাডা এবং মিত্র দেশ বলে পরিচিত ইউরোপের দেশগুলোতেও ট্রাম্পের উচ্চশুল্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে এবং এখনো চলছে।

 

ট্রাম্পের উচ্চহারের শুল্ক ধার্যের ঘোষণা এখন আর আলোচনার পর্যায়ে রাখার সুযোগ নেই, বরং এটি এখন বিশ্বব্যাপী এক শুল্ক হুমকি বা বাণিজ্যযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কেননা ট্রাম্প যেসব দেশের বিরুদ্ধে উচ্চশুল্ক ধার্যের ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেক উন্নত দেশও আছে, যারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। ফলে উচ্চহারে শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে এক ধরনের হুমকি এবং পাল্টাহুমকি শুরু হয়ে গেছে। এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ অব্যাহত থাকলে শুধু যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহে ভয়ংকর এক স্থবিরতা নেমে আসতে পারে।

 

যেমনটি হয়েছিল আজ থেকে কয়েক দশক আগে গ্যাট অর্থাৎ জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড  (GATT)  চালু থাকার সময়।
ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক নীতি কতটা বাস্তবসম্মতদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বিভিন্ন দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে এক ধরনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই গ্যাট স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

 

এর মূলকথা ছিল যে একটি দেশ অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করলে সেই দেশও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিপক্ষ দেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর একইভাবে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের অধিকার রাখে। এভাবে একাধিক দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক ধার্যের ফলে সর্বোচ্চ শুল্কের হার ১০০ শতাংশে পৌঁছেছিল, যার পরিণতিতে বিশ্ববাণিজ্যে এক ধরনের স্থাবিরতা নেমে এসেছিল।

 


এ কারণেই গ্যাট বাতিল করে পরে ডব্লিউটিও (WTO) বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন চালু হয়।
ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক হারের বিষয়টি এই গ্যাটের পরিণতি বরণ করবে কি না, তা হয়তো সময় বলতে পারবে। তবে আপাতত ট্রাম্প যে তাঁর ঘোষিত শুল্কহার নিয়ে এগিয়ে যাবেন, সেটিই সবার  আশঙ্কা। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক হার নিয়ে আছে উদ্বেগ এবং উত্কণ্ঠা। কিভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।

 

 

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম) বার্ষিক সভা এবং সেখানেও আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ট্রাম্পের উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা। অংশগ্রহণকারী নেতাদের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠাও ছিল ট্রাম্পের উচ্চশুল্কের হুমকি নিয়ে। ট্রাম্প যখন শপথ নিয়ে প্রথম দিনেই ডজন ডজন নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করছিলেন, তখন দাভোস মিটিংয়ের আলোচনায় ক্ষান্ত দিয়ে সবার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল ট্রাম্পের জারি করা নির্বাহী আদেশের দিকে। অবশেষে একটি নির্বাহী আদেশও শুল্কসংক্রান্ত না থাকায় উপস্থিত সবাই আপাতত হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।

 


ট্রাম্প যেভাবে নির্বিচারে উচ্চহারে শুল্ক ধার্যের ঘোষণা দিয়েছেন, তা কতটা বাস্তবসম্মত সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে চীন থেকে পণ্য আমদানির ওপর সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করবেন। আবার নিকট প্রতিবেশী দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করবেন। এমন ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণাত্মক বাণিজ্য ঘাটতি আছে, সেসব দেশের বিরুদ্ধে অধিক হারে শুল্ক ধার্য করবেন।

 

এই অধিক হারের শুল্ক কত হতে পারে, তা অবশ্য ট্রাম্প এখনো স্পষ্ট করেননি। আবার আরেক ঘোষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে ব্রিকসের (BRICS) সদস্য দেশের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ধার্য করা হবে। এভাবে একেক দেশের ওপর একেক ধরনের উচ্চশুল্ক হারের ঘোষণা আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

 

 

নির্বিচারে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য করবে কিভাবে, সেটিও এখন আরেকটি বড় প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র তো পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রযুক্তি, ভারী যন্ত্রাংশ, অস্ত্রশস্ত্র, উড়োজাহাজ এবং অন্যান্য ইকুইপমেন্ট উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে সেরা এবং এগুলো ব্যাপক রপ্তানিও করে থাকে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সব কিছুই তো আমদানিনির্ভর।

 

যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সব কিছুই আমদানি করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে জিনিসপত্রের মূল্য এমনিতেই বেশি। এখানকার কমপ্লায়েন্স এবং বিশেষ স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে গিয়ে বাজারে খুচরা মূল্য এমনিতেই বেড়ে যায়। একটি পণ্য ১০ ডলারে আমদানি করলে, তার খুচরা বাজারমূল্য হয় কমপক্ষে ২৫ ডলার।

 

 

উচ্চমূল্যের বাজারে যদি মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা করা হয়, তাহলে সেই পণ্যের বাজারমূল্য আরো বেড়ে যাবে। যে পণ্য আগে ১০ ডলারে আমদানি করা হতো, সেই পণ্যের আমদানিমূল্য দাঁড়াবে ১৬ ডলার, যদি ট্রাম্পের ঘোষিত ৬০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে যে পণ্যটি আগে ২৫ ডলারে বিক্রি হতো, সেটি তখন বিক্রি হবে ৩১ ডলারে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাবে।

 

 

আবার খরচ কমিয়ে যে উচ্চমূল্য ম্যানেজ করবে, সেই অভ্যাস আমেরিকানদের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভোগবাদী এবং ঋণ করে হলেও তারা জীবনযাত্রার মান ধরে রাখে। এ কারণেই রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেমন বিশ্বে সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণও অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ যেমন ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাথাপিছু গড় হাউসহোল্ড ঋণের পরিমাণ বাৎসরিক আয়ের ১৫০ শতাংশের বেশি।

 

অর্থাৎ একজনের বাৎসরিক উপার্জন যদি ৫০ হাজার ডলার হয়, তার হাউসহোল্ড ঋণের পরিমাণ ৭৫ হাজার ডলার। উল্লেখ্য হাউসহোল্ড ঋণ হচ্ছে একজন ব্যক্তির বন্ধকি ঋণ ছাড়া সব ধরনের ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ; যেমন—ক্রেডিট কার্ড ঋণ, লাইন অব ক্রেডিট, গাড়ির ঋণ প্রভৃতি।

 

 

একটি বিষয় নিশ্চিত যে ট্রাম্প যদি সত্যিকার অর্থেই উচ্চ শুল্ক হার কার্যকর করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেডারেল রিজার্ভ তখন নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করবে, যা প্রকারান্তরে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে তখন ঋণের ওপর উচ্চহারে সুদ দিতে হবে।

 

অবস্থা এমন দাঁড়াবে যে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের কারণে, অন্যদিকে এই বর্ধিত ব্যয় মেটাতে তাদের ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে, যার ওপর অধিক হারে সুদ দিতে হবে। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত ঋণের ওপর সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পুনরায় ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, যাকে এককথায় বলা যেতে পারে ঋণের দুষ্টচক্র।  

 

 

এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্র হিসেবে তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও ঋণের ট্র্যাপে বা দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ঋণ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট পারদর্শী, তাই এই ব্যাপক ঋণের নেতিবাচক প্রভাব সেভাবে অনুভূত হয় না। এই পরিমাণ ঋণ যদি বিশ্বের আর কোনো দেশের থাকত, তাহলে সেই দেশ আজ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করত।

 

 

ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক হার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ঋণের যে দুষ্টচক্র, তা আরো খারাপ হবে। এই অবস্থা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেহেতু জানে, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক এবং রিপাবলিকান দলের নেতারাও বেশ ভালোভাবেই জানেন। ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক হার যেভাবে প্রচার পেয়েছে, সেভাবে কার্যকর না-ও হতে পারে। এ কারণেই ট্রাম্প শপথ নিয়ে প্রথম দিন দুই ডজনেরও বেশি নির্বাহী আদেশ জারি করলেও তার মধ্যে একটিও শুল্কসংক্রান্ত নেই।

 

 

এ কথা ঠিক যে ট্রাম্প উচ্চ শুল্ক হার আরোপের হুমকি দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় যেমন ভালো সুবিধা নিয়েছেন, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধের আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এই আতঙ্ক যে অহেতুক নয়, তা বোঝানোর জন্য ট্রাম্প প্রশাসন আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কহার যে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি  করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যেভাবে হুমকি দিয়েছেন, সেভাবে না-ও হতে পারে। ট্রাম্প মূলত এই শুল্কের অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারকে এক ধরনের চাপে ফেলতে চেষ্টা করেছেন।

 

 

সেই সঙ্গে দর-কষাকষির ভালো ক্ষেত্রও প্রস্তুত করছেন। এভাবে চাপ দিয়ে এবং দর-কষাকষির মাধ্যমে যদি কিছু রপ্তানিকারক কম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করা যায়, তাহলে সেটিই হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অর্জন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্ভবত সে পথেই হাঁটছেন এবং সে রকম একটি ইঙ্গিত তিনি এরই মধ্যে দিয়েছেনও। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বক্তব্য প্রদানের এক পর্যায়ে ট্রাম্প স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে ‘হয় আমেরিকায় এসে পণ্য উৎপন্ন করো, নতুবা উচ্চহারে ট্যারিফ দাও।’

 

 

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা