কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

উদ্ভাবন অর্থনীতি ও মুসলিম বিশ্ব

ডিজিটাল রূপান্তরকে আলিঙ্গন করুন। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণের ব্যবধান পূরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রয়াসে সহযোগিতা বৃদ্ধি, মানব মূলধনে বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে, বিশ্বব্যাপী ধারণার পুনর্গঠন এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, মুসলিম দেশগুলোতে এই প্রচেষ্টাগুলোর সাথে সাংস্কৃতিক এবং ইসলামী মূল্যবোধের যৌথতা নিশ্চিত করার দায় থাকে। এ দায় নীতিগত অনুশীলন, ন্যায় নিশ্চিতকরণ এবং সমষ্টির সমন্বিত উন্নয়নে জোর দেয়। আমাদের উদ্ভাবন অর্থনীতিতে তার প্রতিফলন জরুরি-মুসা আল হাফিজ। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

উদ্ভাবন অর্থনীতি ও মুসলিম বিশ্ব

আজকের বিশ্ব অর্থনীতিতে উদ্ভাবন হলো প্রবৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। এটি একটি জাতির নতুন ধারণা তৈরির ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে, উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের সামর্থ্যরে জানান দেয় এবং তার টেকসই বাস্তবায়ন সক্ষমতার প্রতিফলন ঘটায়। ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স (GII) অনুসারে, বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ উদ্ভাবনে উন্নতি করেছে। তারা গবেষণা, উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতির শক্তি প্রদর্শন করেছে।

 

 

সাতটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনী অর্থনীতিতে দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয়েছে। স্তম্ভগুলো হলো, প্রতিষ্ঠান, মানব পুঁজি, অবকাঠামো, বাজার, পরিশীলিত অনুশীলন এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আউটপুট। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে আমরা সবচেয়ে উদ্ভাবনসক্ষম হিসেবে চিত্রিত মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে পারি।

 

১. আরব আমিরাত

চ্যালেঞ্জ : সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল, যা ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যতের বার্তা দেয়। দেশটি দ্রুত নগরায়ণ করছে। ফলে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে, সম্পদ কমছে। এটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত উদ্বেগের কারণ। দুবাইতে রিয়েল এস্টেট খাতে অতিমূল্যায়ন ও অতিরিক্ত সরবরাহ সমস্যা করছে, যার ফলে বাজারে সঙ্কট দেখা দেয়।

অনেক সময় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দ্রুত লাভের আশায় বিনিয়োগ করলেও দীর্ঘমেয়াদে বাজার স্থিতিশীল থাকে না। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০-৯০ শতাংশ প্রবাসী। দেশীয় নাগরিকদের জন্য সরকারি খাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়, কিন্তু বেসরকারি খাতে তাদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম।

‘এমিরাতাইজেশন’ (Emiratization) নীতি চালু থাকলেও এর বাস্তবায়নে রয়েছে বহু বাধা। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে উদ্ভাবন-সক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। দেশটি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ভারসাম্য রক্ষার দিকটি উপেক্ষা করছে। যার ফলে ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। উদ্ভাবনী অর্থনীতি কখনো ঐতিহ্যের বিনিময়ে টেকসই উন্নয়ন কামনা করে না। আখলাকি সঙ্কট আরব আমিরাতের উন্নয়নকে রক্তচক্ষু দেখাতে থাকবে।

 

 

উদ্ভাবনের সড়কে : তা সত্ত্বেও দেশটি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে। ২০২৪ সালে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ৩২তম। বৈচিত্র্য এবং উন্নত প্রযুক্তির ওপর মনোযোগ দেশটিকে একটি আঞ্চলিক উদ্ভাবনী কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি : হোপ প্রোব নামে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের মঙ্গল অভিযান মহাকাশ অনুসন্ধানে তার প্রতিশ্রুতি ও আগ্রহের নজির। মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানো প্রথম আরব দেশ আরব আমিরাত। দুবাইয়ের ‘স্মার্ট সিটি’ নগর দক্ষতা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের চেষ্টায় উচ্চাভিলাষী। শহরটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন ও ইন্টারনেট অব থিংসকে (ওড়ঞ) একীভূত করেছে।

 

 

টেকসই উন্নয়নের চেষ্টা : আবুধাবির মাসদার সিটির মতো প্রকল্পগুলো পরিবেশগত উদ্ভাবনের প্রতি মনোযোগী। এই টেকসই নগর উন্নয়ন নবায়নযোগ্য শক্তির উপর জোর দেয় এবং পরিবেশবান্ধব অনুশীলনে প্রাধান্য দেয়।

 

 

অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য : সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে একটি বৈচিত্র্যময় মডেলে স্থানান্তরিত হয়েছে। দেশটি ফিনটেক, লজিস্টিকস ও পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ রয়েছে।

 

 

২. মালয়েশিয়া : মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে বিব্রত করে মানব ও আর্থিক মূলধনের ঘাটতি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে। উদ্ভাবনের পথে সরকারি তথ্য প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ আরেক সঙ্কট। দেশটির অর্থনীতি যেসব সমস্যা মোকাবেলার পথসন্ধান করছে, তার মধ্যে রয়েছে উচ্চ সরকারি ঋণ, অপর্যাপ্ত কর রাজস্ব ও ভর্তুকির বোঝা। আর্থিক কৌশল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে দেশটিতে। যেমন- গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স পুনরায় কার্যকর করা এবং ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের মতো বিষয়। মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে থেকে থেকে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্কট জেগে ওঠে। এর পেছনে কাজ করে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, চাপা চাহিদা, প্রতিকূল আবহাওয়া, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং রিঙ্গিতের বিপরীতে মার্কিন ডলারের টেকসই শক্তি।

দেশটিতে অর্থনৈতিক বাধার মধ্যে রয়েছে, মূলধন বিনিয়োগের অভাব, ঋণের চাপ, দুর্বল বাণিজ্য শর্ত ও অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি। ডিজিটালাইজেশন ও জলবায়ু পরিবর্তন অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে জটিলতা যোগ করেছে।

 

উদ্ভাবনের সড়কে : এমনতরো চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে মালয়েশিয়া আছে ৩৩তম স্থানে। দেশটি ইসলামিক অর্থায়ন, হালাল শিল্প এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। হালাল উদ্ভাবন এবং নীতিগত ব্যবসায়িক অনুশীলনের জন্য দেশটি বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

 

 

ইসলামিক অর্থায়ন এবং ফিনটেক : মালয়েশিয়া শরিয়াহসম্মত আর্থিক উপকরণে মনোযোগী। দেশটি ক্রমবর্ধমান ফিনটেক ইকোসিস্টেমসহ ইসলামী অর্থায়নে নেতৃত্ব দেয়। মালয়েশিয়া উন্নত ডিজিটাল ব্যাংকিং প্লাটফর্ম তৈরি করেছে এবং এ প্রক্রিয়ায় ইসলামী অর্থায়নের নীতিমালা অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

 

 

ক্স হালাল ইকোসিস্টেম : খাদ্য থেকে শুরু করে প্রসাধনী পর্যন্ত, মালয়েশিয়া একটি শক্তিশালী হালাল শিল্প গড়ে তুলেছে, যা শক্তিশালী সার্টিফিকেশন মান বজায় রাখছে এবং বিশ্বব্যাপী বাজারে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছে।

 

 

শিক্ষা ও গবেষণা : মালয়েশিয়া শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। যেখানে ইউনিভার্সিটি মালায়া এবং ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অত্যাধুনিক গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।

 

 

৩. তুরস্ক

চ্যালেঞ্জ : অর্থনৈতিক সঙ্কট তুরস্ককে চাপ দিচ্ছে অব্যাহতভাবে। এর বৈশিষ্ট্য হলো তুর্কি লিরার মূল্য হ্রাস, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের খরচ বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান ঋণখেলাপি। প্রবৃদ্ধিকে দুর্বল করে এমন দীর্ঘস্থায়ী সামষ্টিক এবং কাঠামোগত বহু চ্যালেঞ্জ তুর্কিয়ের অর্থনীতিকে চোখ রাঙায়। দেশটিতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থা এবং উচ্চাভিলাষী কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

অত্যন্ত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং স্থানীয় মুদ্রার প্রতি আস্থার অভাব ছাড়াও আঞ্চলিক অস্থিরতা তুরস্ককে চাপে রাখে। দেশটির রয়েছে চলতি হিসাবের বৃহৎ ও স্থায়ী ঘাটতি, স্বল্প আন্তর্জাতিক রিজার্ভ এবং বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রার দায়বদ্ধতা। রাজনৈতিক অর্থনীতি ভঙ্গুর ফলাফল নিয়ে হাজির হচ্ছে।

তবে উদ্ভাবনী সামর্থ্যকে আরো বিকশিত করে দেশটি উত্তরণের পথসন্ধান করছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান ভোক্তা বাজার, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে কৌশলগত অবস্থান, বিশাল পর্যটন সম্ভাবনা এবং তরুণ ও উদ্যোক্তা জনসংখ্যা দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়ক।

আধুনিক অগ্রগতির সাথে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে যুক্ত করে এগোতে চাইছে তুরস্ক। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ তুরস্কের অবস্থান। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, স্টার্টআপ সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের মতো ক্ষেত্রে দেশটি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

 

 

মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা : প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে তুরস্ক অগ্রগতির পথে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বায়রাক্টার ড্রোন বিশ্বব্যাপী সামরিক ও নজরদারির উদ্দেশ্যে আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।

 

 

স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম : ইস্তাম্বুল প্রযুক্তি স্টার্টআপগুলোর সমৃদ্ধ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দেশটি ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইনে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করছে।

সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন : সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সাথে প্রযুক্তিকে একীভূত করছে তুরস্ক। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল পর্যটন প্লাটফর্ম এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর পুনরুদ্ধার।

 

 

৪. সৌদি আরব

চ্যালেঞ্জ : সৌদি আরবের কৌশল তিনমুখী তেল-নির্ভরতা থেকে সরে এসে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করা, প্রতিযোগী বিশ্বশক্তির মধ্যে সেতু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহকারী হিসেবে তার ভূমিকা বজায় রাখা। কিন্তু ‘ঠরংরড়হ ২০৩০’ সত্ত্বেও অ-তেল খাতে (যেমন পর্যটন, প্রযুক্তি, বিনোদন) কাক্সিক্ষত মাত্রায় স্থায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। সৌদি আরবের মোট রফতানির প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস খাত থেকে।

 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের ৭৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, যার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মার্কিন বিনিয়োগ নীতিগত পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সৌদিতে যুবসমাজের বেকারত্ব বড় সমস্যা, বিশেষত নারীদের মধ্যে। শিক্ষিত তরুণদের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় খাতেই চাকরির বেশি চাহিদা, বেসরকারি খাতে অংশগ্রহণ কম। দেশটি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে, কিন্তু আইনি জটিলতা, স্থায়ী বাসিন্দা নীতির অনিশ্চয়তা এবং বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতার অভাব বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। শুষ্ক মরুভূমির দেশটিতে পানির অভাব, মরুকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ।

 

 

কৃষি খাত টেকসই নয় এবং অধিকাংশ খাদ্যই আমদানিনির্ভর। মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও উদীয়মান উদ্ভাবক রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সৌদি আরব।

 

 

উদ্ভাবনী অর্জন : বৈশ্বিক সূচকে তার অবস্থান ৪৭তম। উদ্ভাবনের ওপর দেশটি ক্রমবর্ধমান জোর দিচ্ছে। দেশটি ভিশন-২০৩০ প্রোগ্রামের আওতায় নবায়নযোগ্য শক্তি, স্মার্ট সিটি, এআই ও ব্লকচেইনের মতো উন্নত প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।

মূল দিক

টেকসই এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য ডিজাইন করা হয়েছে স্মার্ট সিটি, নিওমের অগ্রগতি হয়েছে। একটি ভবিষ্যৎমুখী প্রকল্প হিসেবে তা বিবেচিত হচ্ছে।

বৈচিত্র্যময় অর্থনীতিতে রূপান্তরের অংশ হিসেবে সৌর ও বায়ুশক্তিতে বিনিয়োগ।

গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিলের দ্রুত বৃদ্ধি, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রকৌশলে অগ্রগতি।

সৌদি আরবের কৌশলগত উদ্যোগগুলো উচ্চাভিলাষী, যা দেশটিকে মুসলিম বিশ্বে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একটি উদীয়মান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

 

 

৫. কাতার

চ্যালেঞ্জ : কাতারের অর্থনীতি প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। মোট রফতানির প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ আসে এলএনজি (Liquefied Natural Gas), অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য থেকে।

বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দামের ওঠানামা কাতারের অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। কাতারের মুখ্য কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো হলো হাইড্রোকার্বনের ওপর উচ্চ এবং অবিরাম নির্ভরতা, যা অন্তর্নিহিতভাবে ভঙ্গুর। কাতার অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে চাইলেও অ-জ্বালানি খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি।

অর্থনীতি এখনো শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেনি। জনসংখ্যার প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ হলো অভিবাসী শ্রমিক, যারা মূলত নির্মাণ, পরিষেবা ও শ্রমনির্ভর খাতে কাজ করে।

 

 

নাগরিক ও অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য এবং কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা সমাজ ও অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। কাতার মরুঅঞ্চল হওয়ায় কৃষিকাজ সীমিত, ফলে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ও পানির প্রাপ্যতা ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হতে পারে। শহরায়ণ, দ্রুত অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন আয়োজনের পরিমাণগত ব্যয়ের মতো বিষয় পরিবেশগত ভারসাম্য এবং বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করেছে।

 

 

উদ্ভাবনী অর্জন : তবুও কাতার উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একটি উদীয়মান শক্তি। ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে দেশটির অবস্থান ৪৯তম। শিক্ষা, স্থায়িত্ব এবং ক্রীড়া প্রযুক্তির ওপর দেশটির মনোযোগ। একটি অগ্রগামী চিন্তাশীল রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে হাজিরের ক্রমাগত চেষ্টা কাতারের মধ্যে লক্ষণীয়।

 

 

শিক্ষা শহর

কাতারের শিক্ষা শহরে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কার্নেগি মেলনের মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। একটি জ্ঞান-চালিত অর্থনীতির অভিপ্রায়ে শহরটি গতিমান।

টেকসই উদ্যোগ : কাতার সৌরশক্তি প্রকল্প এবং সবুজ ভবন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে। আল-খারসাহ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি নজির, যা এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র।

ক্রীড়া ও স্থাপত্য প্রযুক্তি : স্টেডিয়াম ডিজাইনসহ স্থাপত্যকর্মে কাতারের উদ্ভাবন লক্ষণীয়। উন্নত শীতল ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশটি নতুনত্ব প্রদর্শন করেছে।

 

 

৬. ইন্দোনেশিয়া

চ্যালেঞ্জ : ইন্দোনেশিয়া বিশাল ভূখণ্ড। এটি হাজার হাজার দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল এবং পরিবহন খরচ বেশি। অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ থাকলেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয়, বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরি তৈরি হচ্ছে না।

 

 

অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে, যেখানে মজুরি ও চাকরির নিরাপত্তা কম। শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে বড় ধরনের আয়বৈষম্য রয়েছে। অনেক প্রদেশে এখনো দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি, বিশেষত পূর্ব ইন্দোনেশিয়ায়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি অনেকটাই প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষিপণ্য রফতানির ওপর নির্ভরশীল, যেমন পামঅয়েল, কয়লা, খনিজ। বৈশ্বিক বাজারে দামের ওঠানামা বা চাহিদা কমে গেলে রফতানি আয় হ্রাস পায়। প্রশাসনিক ধীরগতি, দুর্নীতি ও অদক্ষ নীতিমালা অনেক সময় বিদেশী বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। শ্রমবাজারে যোগ্য ও দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে।

 

 

অনেক তরুণের শিক্ষাগত মান কম, ফলে প্রযুক্তিনির্ভর খাতে তাদের নিয়োগ কঠিন হয়। বন উজাড়, পামঅয়েল শিল্পের পরিবেশ ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইন্দোনেশিয়ার কৃষি, স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে। তবে সঙ্কট উত্তরণে দেশটি উদ্ভাবনী দক্ষতা প্রদর্শন করছে।

 

 

উদ্ভাবনী অগ্রগতি : ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ান অবস্থান ৫৪তম। দেশটি ডিজিটাল রূপান্তর এবং নবায়নযোগ্য শক্তিতে ব্যতিক্রমী অগ্রগতি প্রদর্শন করেছে।

 

 

ডিজিটাল অর্থনীতি : ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডিজিটাল অর্থনীতিতে শীর্ষস্থানীয়। দেশটিতে গোজেক এবং টোকোপিডিয়ার মতো ইউনিকর্ন স্টার্টআপগুলো অসাধারণ অগ্রগতি লাভ করেছে। বলতে গেলে ই-কমার্স, রাইড-হেলিং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ফলে পরিষেবাগুলোতে দেশটি বিপ্লব ঘটিয়েছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি : প্রচুর ভূ-তাপীয় সম্পদ কাজে লাগিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। নবায়নযোগ্য শক্তিতে অগ্রগতি করেছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করেছে।

 

 

সরকারি উদ্ভাবন : ই-সরকারের উদ্যোগগুলো জনসাধারণের পরিষেবা উন্নত করছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এর সুফল দৃশ্যমান। শহরের সাথে গ্রামের দক্ষতার ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছে দেশটি।

 

উদ্ভাবন অর্থনীতিতে অগ্রগামী এই রাষ্ট্রগুলো মুসলিম জাহানের অন্য রাষ্ট্রদের কিছু বার্তা দিচ্ছে। যেমন

১. শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিন। শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. স্টার্টআপগুলোকে উৎসাহিত করুন। উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করুন।

৩. টেকসই উন্নয়নে মনোযোগ দিন। টেকসই প্রকল্পগুলো উদ্ভাবন কৌশলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পরিবেশবান্ধব অনুশীলনও সেই সাথে জরুরি।

 

 

৪. ডিজিটাল রূপান্তরকে আলিঙ্গন করুন। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণের ব্যবধান পূরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রয়াসে সহযোগিতা বৃদ্ধি, মানব মূলধনে বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে, বিশ্বব্যাপী ধারণার পুনর্গঠন এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, মুসলিম দেশগুলোতে এই প্রচেষ্টাগুলোর সাথে সাংস্কৃতিক এবং ইসলামী মূল্যবোধের যৌথতা নিশ্চিত করার দায় থাকে। এ দায় নীতিগত অনুশীলন, ন্যায় নিশ্চিতকরণ এবং সমষ্টির সমন্বিত উন্নয়নে জোর দেয়। আমাদের উদ্ভাবন অর্থনীতিতে তার প্রতিফলন জরুরি।

 

লেখক : কবি, গবেষক