কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ

জাতিসংঘের রেটিং অনুসারে বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথামিক তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ কোনো দুর্বিপাক না ঘটলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক একটি সংবাদ। কারণ কোনো দেশই দরিদ্র বা স্বল্পোন্নত দেশ হয়ে থাকতে চায় না।

 

 

 

এটি মর্যাদাহানিকর। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কিভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল এবং পরবর্তী সময়ে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় স্থান লাভ করার জন্য যে তিনটি আবশ্যিক শর্ত পালন করতে হয়, বাংলাদেশ তার প্রতিটিতেই ভালো করেছে। কাজেই উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উন্নীত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

 

 

 

কিন্তু বাংলাদেশ যে তথ্য ও পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এই অর্জন করতে চলেছে, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য? অন্তর্বর্তী সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা বলেছেন, বিগত সরকার অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শনের জন্য যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তার বেশির ভাগই অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিকর।

 

 

 

উল্লেখ্য, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং এ ধরনের আরো কিছু ইস্যুতে যে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছে, তা উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) প্রক্ষেপিত তথ্যের সঙ্গে মেলে না। প্রতিবছর বাংলাদেশ জিডিপি অর্জনের যে হার প্রদর্শন করে, উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গে তার অন্তত এক থেকে দেড় শতাংশ পার্থক্য থাকে। বছরান্তে কোনো পক্ষই তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে সরে আসে না।

 

 

এটি কী করে সম্ভব? নির্দিষ্ট বছরে একটি দেশের অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তো দুই রকম হতে পারে না। তাহলে আমরা কার দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্বাস করব? ভঙ্গুর ফাউন্ডেশনের ওপর ভবন নির্মাণ করলে যেমন তা টেকসই হয় না, তেমনি বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে, তা কখনোই বাস্তবে পরিণত হতে পারে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যদি আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হতে চায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। কারণ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধাসহ নানা রকম সুবিধ হারাতে হবে।

 

 

দেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন কিছুদিন আগে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময়সীমা ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

 

 

 

তারা বলেছে, বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার মতো উপযুক্ততা অর্জন করেনি। এই অবস্থায় যদি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয়, তাহলে যে অভিঘাত সৃষ্টি হবে অর্থনীতির ওপর, তা সামাল দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনের এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকেই অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পেয়ে থাকেন।

 

 

জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আরো তিন বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখবে। তারপর তা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি+ নামে নতুন এক ধরনের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে, তা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন হবে।

 

 

 

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪৮ শতাংশেরও বেশি আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। ২০০০-০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মোট ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল। ২০ বছরের ব্যবধানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

 

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি উৎপাদন সক্ষমতা ও পরিমাণ এবং গুণগত মান বাড়াতে পারে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ আরো ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীর একক বৃহত্তম গন্তব্য হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক সামগ্রী থেকে। এর বেশির ভাগই রপ্তানি করা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। কোনো কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো রপ্তানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

 

 

 

বিগত সরকারের আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে নানা কল্পকাহিনি প্রচার করা হলেও রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানি গন্তব্যে ভিন্নতা আনয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সীমিতসংখ্যক দেশ ও সামান্য কিছু পণ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আমরা যেসব দেশ বা অঞ্চলে বেশি হারে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করি, সেসব এলাকা থেকে আমাদের পণ্য আমদানির পরিমাণ খুবই কম।

 

 

আবার যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করি, সেসব দেশে আমাদের রপ্তানির হার খুবই কম। যেমন—বাংলাদেশ চীন ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য ও সেবা আমদানি করে থাকে। কিন্তু এই দেশ দুটি বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়, বরং নানা ধরনের অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের পণ্য তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হলেও এই দুটি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ খুবই সামান্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

 

 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রয়োজন। আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ না হয়ে বরং এর সময়সীমা অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে যে সময় পাওয়া যাবে, তাকে বাণিজ্য বিনিয়োগ উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে রপ্তানি পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন এবং উৎপাদিত পণ্য বহুমুখী করতে হবে। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে রপ্তানি পণ্যের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবে।

 

 

 

বাণিজ্য-বিনিয়োগ আহরণের জন্য আমাদের ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি বা অর্থনৈতিক কূটনীতি গ্রহণ করা জরুরি। অর্থনৈতিক কূটনীতি এখন বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত এবং সমাদৃত একটি উন্নয়ন কৌশল। অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল বিষয় হচ্ছে কোনো দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বার্থ বা ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। অর্থাৎ যেকোনো দেশের সঙ্গেই আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টি এবং উন্নয়ন হতে পারে, যদি সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অর্জিত হয়। বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে আমি অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। অনেক দেশের কূটনীতিকরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব প্রদান করেন দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থকে। অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছে—এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন দেশে যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা অর্থনৈতিক কূটনীতির ব্যাপারে খুব একটা সচেতন নন। তাঁরা অনেকটাই রুটিন দায়িত্ব পালন করেন মাত্র।

 

 

প্রতিটি দূতাবাসে ইকোনমিক উইং আছে বটে, কিন্তু তাদের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তাঁরা দেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারেই বেশি তৎপর থাকেন। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা খুব একটা বেশি নেই, সেসব দেশে অর্থনৈতিক কূটনীতি চালানো যেতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। বিশেষ করে অর্থনীতি সম্পর্কিত অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতাম। এতে প্রতীয়মান হতো যে চেষ্টা করলে একজন রাষ্ট্রদূত তাঁর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারেন।

 

 

 

অর্থনীতি আবেগ দিয়ে চলে না। তাই আমাদের উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে বারবার চিন্তা করতে হবে, এটি আমাদের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে। এই পর্যায়ে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলেও পরবর্তী সময়ে যদি কোনো কারণে আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তাহলে আবারও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেমে আসতে হতে পারে। কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে।

 

 

তাই উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমাদের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেগ নয়, যুক্তিই হতে হবে উপজীব্য। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে যেসব উন্নয়ন কার্য সম্পাদিত হয়েছে, তার বেশির ভাগই টেকসই নয়। এই অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ সাফল্য অর্জনের চেয়ে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।   

 

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত