উত্তাপ ছড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাগ্যুদ্ধ
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ। সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১২ এপ্রিল ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য তিনি বেইজিং থেকে একটি ফোন কলের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু চীন ‘সমতা, সম্মান ও পারস্পরিক লাভ’ দাবি করে যেকোনো আলোচনার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ‘শেষ পর্যন্ত লড়বে’। এই অবস্থায় স্পষ্ট, বিশে^র দুই দেশের বৃহত্তম অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে এবং কার্যত হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। ট্রাম্পের শুল্প আরোপের ঘোষণার পর, বিপুল ক্ষতি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশি^ক স্টক মার্কেটগুলো শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদিও অবস্থান কঠিন হয়ে উঠেছে এবং সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে আর আমেরিকার অভ্যন্তরেও পরিস্থিতি অনিশ্চিত।
বিলিয়নিয়ার এবং ব্যবসায়িক অভিজাতরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার ট্যারিফ হামলা বন্ধ করতে অনুরোধ করেছেন এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হাজার হাজার বড় ও ছোট মার্কিন করপোরেশন ও ব্যবসার প্রতিনিধিত্বকারী ইউএস চেম্বার অব কমার্স ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্য নষ্ট করার প্রচেষ্টা থামাতে, নিজেদের সরকারকে আদালতে দেওয়ার কথাও বিবেচনা করছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাতে তো দমেনইনি বরং চীনকে বিদ্রুপ ও নিন্দা অব্যাহত রেখেছেন। অন্যদিকে দাবি করেন যে, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অনেক দেশের সঙ্গে কাজ করছি, যাদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়।’
তিনি জাপান ও ভিয়েতনামের নেতাদের যোগাযোগের কথাও বলেন। তবে ভারতের কথা উল্লেখ করেননি, যারা কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দলের সঙ্গে শান্তভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, প্রক্রিয়াটি আরও কয়েক সপ্তাহ চলবে। ‘চীনও একটি চুক্তি করতে চায়, কিন্তু তারা কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। আমরা তাদের ফোন কলের অপেক্ষায় আছি। এটা হবে!’ তিনি এক্স-এ (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টে এমন কথা বলেন। তবে ট্রাম্প শুধু বাণিজ্য ও শুল্কেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বিশ^ব্যাপী তার যুদ্ধ আরও নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলে ফেলেছেন, মিত্রদের কাছ থেকে সুরক্ষার বিনিময়ে অর্থ দাবি করার মতো। “দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে যেমন, আমরা অন্য বিষয়গুলোও উত্থাপন করছি, যা বাণিজ্য ও শুল্কের মধ্যে পড়ে না এবং সেগুলোও আলোচনার আওতায় আনছি। ‘ওয়ান স্টপ শপিং’ একটি চমৎকার ও কার্যকর প্রক্রিয়া!” তিনি বলেন। কিন্তু বেইজিং থেকে কোনো ফোন আসার বদলে, চীন যেভাবে ‘চাষা’, ‘চোর’ ও ‘আবর্জনা খোঁজার লোক’ ইত্যাদি বলে অপমানিত হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছে, ‘ভয় দেখানো, হুমকি এবং ব্ল্যাকমেইল চীনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সঠিক উপায় নয়’ এবং ‘কেউ চীনা জনগণের ন্যায্য উন্নয়নের অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না।’
‘যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কথা বলতে চায়, তবে তাদের দেখাতে হবে যে তারা অন্যদের সমতা, সম্মান ও পারস্পরিক লাভের ভিত্তিতে দেখতে প্রস্তুত। যদি যুক্তরাষ্ট্র চীন ও বাকি বিশ্বের স্বার্থ উপেক্ষা করে এবং ট্যারিফ বা বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে চীনের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত চলবে’, বেইজিংয়ে এক চীনা মুখপাত্র বলেন। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম বাজফিড একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে, একটি এখন ভাইরাল হওয়া ক্লিপে, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স চীনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সরাসরি চীনা জনগণকে অপমান করেছেন। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে : ‘যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স কিছু করতে পারেন, তবে সেটি হচ্ছে সারা বিশে^র কাছে আমেরিকানদের লজ্জিত করা।’ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভ্যান্সের মন্তব্যে মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেছে।
‘সত্যিই, ২০২৫ সালে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট কীভাবে চীনা জনগণকে ‘কৃষক’ বলে পার পেয়ে যায়?’ একজন মন্তব্য করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘চীনা কৃষক’রা বিশ্বের বৃহত্তম হাই-স্পিড রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, সবচেয়ে উন্নত বৈদ্যুতিক যানবাহন চালায়, তারা এমন একটি দেশে থাকে যেখানে অপরাধ অনেক কম, স্বাস্থ্যসেবা আরও ভালো ও সাশ্রয়ী, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কম এবং তাদের শহরগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও ভবিষ্যৎমুখী। কিন্তু এই লোকটা ক্ষেপে আছেন, কারণ চীন দরিদ্রই থেকে যেত এবং আমেরিকার উপকারের জন্য একটি কেবলমাত্র উৎপাদন-নির্ভর দেশ হয়ে থাকত তার এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। আমি চাই জেডি ভ্যান্স যেন চীন যান এবং সত্যিটা নিজের চোখে দেখেন।
ভান্স ছাড়াও, মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, চলতি বছরের শেয়ারবাজার ধসের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির চেয়ে চীনের DeepSeek নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির আবির্ভাব বেশি দায়ী। সম্প্রতি রয়টার্স খবরটি প্রকাশ করে। তিনি বলেন : ‘যারা মনে করছেন বাজার পতন শুধুই প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক নীতির কারণে, তাদের বলব এই পতন শুরু হয়েছে চীনের DeepSeek ai ঘোষণার পর থেকেই।’ তিনি আরও বলেন : “যদি আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলি এবং এটা একবারই বলছি বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে আমি বলব, এটা MAGA (ট্রাম্প সমর্থিত আন্দোলন) নয়, বরং ‘MAG ৭’ সমস্যার ফলাফল।” (বেসেন্ট পূর্বে একটি হেজ ফান্ড পরিচালনা করতেন, সেখান থেকে তাকে ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।)
এই কথার পাল্টাপাল্টি উভয় পক্ষই মনে করছে যে, তাদের হাতে বেশি শক্তি ও চাপের উপায় রয়েছে এবং এখন প্রশ্ন কে আগে নতি স্বীকার করে। অনেক বিশ্লেষক বলেন, ওয়াশিংটন চীনকে কোণঠাসা করে ভুল করছে, কারণ চীনা নেতৃত্ব দেশের অভ্যন্তরে মুখ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে সেটি তাদের জন্য মারাত্মক হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক