কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

উত্তেজনাকর বিশ্ববাণিজ্য পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি

নিরঞ্জন রায় । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উত্তেজনাকর বিশ্ববাণিজ্য পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি

বাংলাদেশ ব্যাংক অতি সম্প্রতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। প্রতিবারই মুদ্রানীতি ঘোষণার মূল লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান সময় মুদ্রানীতি ঘোষণার জন্য মোটেই সহায়ক নয়। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো সেভাবে ফিরে আসেনি।

 

 

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্ববাণিজ্যে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ রকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা বেশ কঠিন কাজ, বলা যায় প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া বর্তমান অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের দেড় মাস এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে। তাই বাকি সময়ের জন্য ঘটা করে মুদ্রানীতি না করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো।

 

 

কিন্তু সেটি তো সম্ভব নয়। তাই কিছুটা নিয়ম রক্ষার বাধ্যবাধকতা থেকে এবারের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, যে কারণে এই মুদ্রানীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে—১. নীতি সুদ হারে কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি। এই সুদের হার আগেও ১০ শতাংশ ছিল, এখনো তা-ই রাখা হয়েছে।
 
 
২. বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯.৮০ শতাংশ। ৩. সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭.৫০ শতাংশ। ৪. বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মতো নীতি সহায়তার (পলিস সাপোর্ট) অভাব। ৫. নতুন টাকা ছাপিয়ে মুদ্রার (রিজার্ভ মানি) সরবরাহ বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত এবং ৬. মূল্যস্ফীতির লাগাম টানাই মূল লক্ষ্য।

 

 

যেকোনো দেশের মুদ্রানীতির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি যদি বেশি থাকে, তাহলে সেটি হ্রাস করার চেষ্টা অথবা মূল্যস্ফীতি যখন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম থাকে, তখন সেটি বৃদ্ধি করার চেষ্টা। এই প্রচেষ্টা সফল করার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পন্থা হচ্ছে নীতি সুদ হার বা পলিসি ইন্টারেস্ট রেট। এ কারণেই মুদ্রানীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত বিষয় হচ্ছে নীতি সুদ হার এবং মূল্যস্ফীতির অবস্থা। মুদ্রানীতির শর্ত অনুযায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় নীতি সুদ হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা থাকবে, এটিই স্বাভাবিক।

 

বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই পদক্ষেপ নিয়ে থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই কাজটি করেছে। এ ছাড়া তাদের কোনো উপায়ও নেই। দেশে যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত রেখে আগের মতোই ১০ শতাংশ বহাল রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে আগামী ছয় মাস এই সুদের হার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ এ বছর সুদের হার হ্রাস পাবে না এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা, নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত থাকার কারণে মূল্যস্ফীতি আগামী জুন-জুলাই নাগাদ হ্রাস পেয়ে ৭-৮ শতাংশে নেমে আসবে এবং ২০২৬ সালে আরো হ্রাস পেয়ে ৫ শতাংশে নেমে আসবে। আমরাও এমনটিই প্রত্যাশা করি। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটবে কি না, তা হয়তো সময় বলতে পারবে। তবে কাজটি মোটেই সহজ হবে না। এমনিতেই আমাদের দেশে নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই।

 

 

কেননা আমাদের দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক উপাদানের চেয়ে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদানের প্রাধান্যই সবচেয়ে বেশি, যার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই। আর অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান ঠিক না করে শুধু নীতি সুদ হার বাড়িয়ে রেখে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি বেশ কঠিন হবে। মাঝখান থেকে দেশের বিনিয়োগে গতি আসবে না। আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যেহেতু অতিমাত্রায় ব্যাংকঋণ নির্ভর, উচ্চ সুদের হারের কারণে ব্যবসায়ীদের আর্থিক খরচ বেশি থাকবে, যা প্রকারান্তরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

 

 

এই মুদ্রানীতিকে সংকুচিত বা সম্প্রসারিত মুদ্রানীতির কোনোটিই বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কেননা সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য সেভাবে বৃদ্ধি করা হয়নি। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ডিসেম্বরের ৭.২৮ থেকে বৃদ্ধি করে ৯.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি হবে ২.৫২ শতাংশ। পক্ষান্তরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য গত ডিসেম্বরের ১৮.১০ থেকে সামান্য হ্রাস করে ১৭.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে মাত্র ০.৬০ শতাংশ।

 

 

যেহেতু সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের পরিমাণ বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের চেয়ে অনেক বেশি, তাই সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ০.৬০ শতাংশ হ্রাস করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২.৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করার কারণে দেশের অর্থনীতিতে সার্বিক ঋণপ্রবাহ সেভাবে বৃদ্ধি পাবে না। এ কারণেই এই মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক বা সম্প্রসারণমূলক—এর কোনোটিই বলার সুযোগ নেই। এককথায় আগের মেয়াদের মুদ্রাস্ফীতির ধারাবাহিকতাই বলা যেতে পারে।

 

 

এবারের মুদ্রানীতিতে একদিকে যেমন উচ্চ নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অর্থনীতিতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি করা হয়নি। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ সেভাবে উৎসাহিত হবে না। ব্যবসায়ীদের জন্য নিশ্চয়ই এটি ভালো সংবাদ নয়। এই মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মতো যে কোনো পদক্ষেপ নেই, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অকপটে স্বীকারও করেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে ২০২৪-২৫ অর্থবছর বিনিয়োগ বৃদ্ধির সময় নয়।

 

 

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে বিরাজমান অনিশ্চয়তার সময় বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ থাকে না এবং সেই আশা না করাই ভালো। তবে বৃহৎ আকৃতির বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা না গেলেও ব্যবসার অগ্রগতি বজায় রাখার স্বার্থে স্বাভাবিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি স্বাভাবিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত না থাকে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থবিরতা নেমে আসবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে না, বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে, দ্রব্যমূল্যও বেড়ে যেতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে। এমনকি দেশে মন্দা অবস্থাও দেখা দিতে পারে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো নয়।

 

যে মুহূর্তে দেশের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, ঠিক তখন সমগ্র বিশ্বে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার উপক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ঘোষিত উচ্চ শুল্ক হার আরোপ করে একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারি করতে শুরু করেছেন। অনেক দেশও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উচ্চ শুল্ক হার আরোপের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপের হুমকির কারণে বিশ্ব এখন এক বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছে। ফলে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে বা কোন দিকে মোড় নেবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগের শেষ নেই। এর ফলে সমগ্র বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর প্রভাব আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কিছুটা পড়বে বলে ধারণা করা যায়।

 

 

মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা সেভাবে বোঝা যায়নি। তবে নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত রাখার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। কেননা গত বছর বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার না কমিয়ে বৃদ্ধি করেছিল। এখন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার হ্রাসে বিরতি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে। বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি তাদের নীতি সুদ হার অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে সেই বিবেচনায় হয়তো সিদ্ধান্তটি ঠিকই আছে। তবে মুদ্রানীতিতে বিষয়টির সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।

 

 

দেশের এবং বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা করাই একটি কঠিন কাজ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যে সেই কাজটি করতে পেরেছে, সেটিই সবচেয়ে বড় কথা। আমাদের দেশের মুদ্রাব্যবস্থা এখনো সুশৃঙ্খল কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পারেনি। এ রকম মুদ্রাব্যবস্থায় মুদ্রানীতি দিয়ে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দৃষ্টান্ত খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তাই এবারের মুদ্রানীতির ফলাফলও যে দৃশ্যমান কিছু হবে, তেমনটা আশা করা কঠিন। তবে মূল্যস্ফীতি যদি কিছুটা হ্রাস পায়, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন। এর পাশাপাশি দেশের ব্যবসায় যেন গতি ফেরে, সেই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা দেশের ব্যবসায়ীরা এমনিতেই নানা রকম সমস্যার মধ্যে আছেন। এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্বব্যাপী যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে ব্যবসায়ীদের ওপর।

 

 

এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা যাতে স্বাভাবিক ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালু রাখতে পারেন, সে জন্য তাঁদের প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। মুদ্রানীতির মাধ্যমে তাঁদের অনেক বেশি সহযোগিতা প্রদানের সুযোগ আছে এবং সেই সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। যদিও মুদ্রানীতি এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়ে গেছে, তার পরও কিছু সার্কুলার বা পরিপত্র জারির মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু নীতি সহায়তা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে।

 

 

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট

ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা