ভারত-মার্কিন সংকটে যেভাবে চীন ও পাকিস্তান উপস্থিত
সুমিত গাঙ্গুলি [প্রকাশ: সমকাল, ০৬ আগস্ট ২০২৫]

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক অগ্রগতির পর ভারত-মার্কিন সম্পর্ক হঠাৎ এক পরিবর্তনের পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক মাস পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র প্রদান করবে। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ঘটনা আগামী দিনের গতিপথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রথম উদ্বেগজনক লক্ষণটি দেখা দেয় পেহেলগাম সংকটকালে। সংক্ষিপ্ত ও তীব্র সংকট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, উভয় পক্ষের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে তিনি সংঘাতের অবসান ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর প্রাথমিক দাবিতে দ্বিগুণ জোর দিয়েছেন, যদিও তাঁর ভারতীয় প্রতিনিধিরা সেই সত্যতা অস্বীকার করে চলেছেন। পরিস্থিতি আরও জটিল করতে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স কাশ্মীর বিরোধের অবসানে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই তিনি জানতেন না, ১৯৬২ সালের নভেম্বরে হ্যারিম্যান-স্যান্ডে মিশন আকারে শেষ ইঙ্গ-মার্কিন প্রচেষ্টা অনেক দুর্বল ভারতের বিরুদ্ধে কোনো অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
নয়াদিল্লির দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল এই দাবিগুলোই উদ্বেগজনক লক্ষণ ছিল না। সংকট শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই ট্রাম্প পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মার্কিন-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে এটিই প্রথমবারের মতো ঘটনা, যেখানে কোনো পাকিস্তানি সেনাপ্রধানকে এই বিরল সম্মান দেওয়া হয়।
নিঃসন্দেহে এসব ঘটনা নয়াদিল্লিতে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এগুলোকে আরও বিস্তৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখা প্রয়োজন। আজ পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন নয়াদিল্লিতে একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি। সংকটের সময় এবং তার পরও রিপাবলিকান শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম নিশ্চিত করেনি, যিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তদারকির জন্য সর্বোচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা।
পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে এই সপ্তাহে ট্রাম্প ওয়াশিংটন ডিসিতে একাধিকবার ভ্রমণকারী ভারতীয় বাণিজ্য আলোচকদের সদিচ্ছার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এই শুল্কা আরোপের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, ভারত রাশিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেট্রোলিয়াম এবং এখনও প্রচুর পরিমাণে রাশিয়ান অস্ত্র কিনছে।
ট্রাম্প যা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন তা হলো, সম্ভাব্য শুল্কের এই সাম্প্রতিক দফা ভারতকে তাৎক্ষণিক ছাড় দিতে প্ররোচিত করার চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৌশলগত সুযোগ আরও বেশি সীমিত করতে পারে। বহিরাগত চাপের মুখে এবং কমপক্ষে দুটি অভ্যন্তরীণ কারণ তাঁকে ঘিরে রেখে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা বেশ সীমিত হতে পারে। প্রথমত, যেমনটি সর্বজনবিদিত তাঁর সরকার বিহারে একটি কঠিন নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সংসদের বর্তমান বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিরোধীরা তাঁর সরকারকে খোঁচা দিচ্ছে, যাতে পেহেলগাম সংকটের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আনতে মার্কিন চাপ কতটা ভূমিকা পালন করতে পারে বা নাও করতে পারে, তা স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়।
তবে এসব বিষয় নয়াদিল্লিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের একমাত্র উৎস নয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে তাদের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানো, এমনকি ট্রাম্প ও শি জিন পিংয়ের মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন বিষয়ে আলোচনা করছেন। প্রকৃতপক্ষে উভয় ক্ষেত্রেই কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে অনুমান করা যুক্তিসংগত। বর্তমান তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চেং-তেকে আসন্ন লাতিন আমেরিকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বিমানে ভ্রমণ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাই এ ধরনের অনুমান মোটেও অযৌক্তিক নয়। নিঃসন্দেহে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেমে থাকতে বলা হয়েছিল। কারণ পিআরসি কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে উচ্চপদস্থ তাইওয়ানীয় কর্মকর্তাদের এ ধরনের সফর বা এমনকি মাঝপথে বিরতি নিতে আপত্তি জানিয়েছেন।
৩০ জুলাই এক্সে ট্রাম্পের আকস্মিক ঘোষণায় তাঁর প্রশাসন পাকিস্তানের তেলের মজুত অনুসন্ধান ও উন্নয়নের জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা নয়াদিল্লিতে আরও উদ্বেগ ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলবে। এটি এমন এক সময়ের ঘটনা যখন মার্কিন-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইতোমধ্যে মন্দার মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রতি প্রশাসন কতটা গুরুত্ব দেয়, তা নিয়ে আরও সন্দেহ জোরদার করবে। ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেকটাই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া মোদি হয়তো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, প্রথম মেয়াদে তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠা আপাত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দ্বিতীয় মেয়াদে স্বাগত নীতিগত পছন্দে রূপান্তরিত নাও হতে পারে। অন্যদিকে, স্বল্পমেয়াদি লাভের সন্ধানে ট্রাম্প গত দুই দশক ধরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনের মধ্যে যে সদিচ্ছা ও বিশ্বাস এত পরিশ্রমের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল, যা তিনি অনেকটাই নষ্ট করতে পারেন। এ ধরনের ফলাফল উভয় পক্ষেরই ক্ষতি করবে।
সুমিত গাঙ্গুলি: সিনিয়র ফেলো এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হুভার ইনস্টিটিউশনের হান্টিংটন প্রোগ্রামের পরিচালক; দ্য ইন্ডিয়ান
এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তরিত