কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভারত ও পাকিস্তান দ্বন্দ্ব : বিশ্ব কি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?

ইয়ান হল [সূত্র : ইত্তেফাক, ০৮ মে ২০২৫]

ভারত ও পাকিস্তান দ্বন্দ্ব : বিশ্ব কি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়েছে ভারত। ইসলামাবাদের দাবি, এ ঘটনায় ভারতের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেছে তারা। এই লেখা পর্যন্ত পাকিস্তানও ভারতের ওপর পালটা হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে। বলা বাহুল্য, এই উত্তেজনা দুই দেশকে নিয়ে এসেছে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। 

 


দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। ফলে এ ঘটনাকে 'একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি' হিসেবে অভিহিত করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সাম্প্রতিক এ দ্বন্দ্ব দেশ দুটিকে চরম উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। 

 


নয়াদিল্লির বক্তব্য, গত মাসে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্রে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা পাকিস্তানে এ হামলা চালায়। যদিও ইসলামাবাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

 


ভারতের হামলার পর পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দাবি করেন, হামলায় ড্রোনসহ 'সূক্ষ্ম স্ট্রাইক ওয়েপন ব্যবস্থা' ব্যবহার করেছে দিল্লি। যদিও আদতে কী ঘটেছে, তা নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আমরা এর আগেও এ ধরনের সংকট প্রত্যক্ষ করেছি। বহু বছর ধরেই পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধ করে আসছে তারা। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে দিল্লি-ইসলামাবাদকে বৃহৎ সংঘাতে জড়াতে দেখেছে বিশ্ব। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে সীমান্তে পালটাপালটি আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, এসব সংঘাত বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে পরিচালিত হয়নি। বরং সংঘাতগুলো সীমিতই ছিল। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। 

 

 


ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আর এ কারণে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিলে উভয় পক্ষই যথেষ্ট সংযমী আচরণ করে থাকে। অতীতে বহুবার তারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে এলেও দিন শেষে একধরনের বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি হতে দেখা গেছে। তাদের বোঝানো গেছে যে, একটি পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধের পরিণতি হবে খুবই বিপজ্জনক। এই বাস্তবতা বিশ্বনেতৃত্বেরও বেশ ভালো করেই জানা। ফলে উভয় পক্ষের ওপর তারা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে অবলম্বন করা হয় বাড়তি সতর্কতা। স্পষ্ট করে বললে, উভয় পক্ষই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে যথেষ্ট চাপের মুখে ছিল, যাতে সংঘাতগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। 

 

 


এবারের ঘটনার পরও উভয় পক্ষ একই রকম সংযম প্রদর্শন করবে বটে। তবে আগের মতো বাইরে থেকে তারা ততটা চাপের মুখে পড়বে বলে মনে হচ্ছে না। সে ধরনের প্রেক্ষাপটে উত্তেজনা দ্রুত গতিতে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সমরবিদরা। তাদের সতর্কবার্তা হলো, বাইরের পক্ষগুলোর চাপ না থাকলে, উত্তেজনা প্রশমিত করা না গেলে এবং উভয় পক্ষকে পিছু হটতে বাধ্য করা না গেলে আরত ও পাকিস্তান তো বটেই, গোটা এ অঞ্চলটাই চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। 

 

 

ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আর এ কারণে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিলে উভয় পক্ষই যথেষ্ট সংযমী আচরণ করে থাকে। অতীতে বহুবার তারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে এলেও দিন শেষে একধরনের বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি হতে দেখা গেছে। তাদের বোঝানো গেছে যে, একটি পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধের পরিণতি হবে খুবই বিপজ্জনক 

 

ভারতের দাবি, কাশ্মীর হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছে। রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামক একটি গোষ্ঠী হামলার পর দায় স্বীকার করে, কিন্তু পরবর্তীকালে তা প্রত্যাহারও করে নেয়। অর্থাৎ, এ হামলার বিষয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা বা ধোঁয়াশা রয়েই যায়। ভারতীয় সূত্রগুলো মনে করে, তুলনামূলক নতুন এ গোষ্ঠীটি জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একটি সম্প্রসারিত অংশ। 

 


লস্কর-ই-তৈয়বা বহু বছর ধরে পাকিস্তানে অবস্থান করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে বলে দিল্লির অভিযোগ। যদিও পাকিস্তান বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে অতীতে এমন একাধিক প্রমাণ রয়েছে যে, পাকিস্তান সরকার তার ভূখণ্ডে বসে অপারেশন পরিচালিত করা এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন না দিলেও, পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠান বা সামরিক বাহিনীর কিছু অংশ তাদের সমর্থন দিয়ে থাকে। আদর্শিকভাবে, আর্থিকভাবে বা অন্য উপায়ে তারা এই সহায়তা করে থাকে। 

 

ভারত বারবার পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে। দেশের মাটিতে বসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ করতে আহ্বান জানাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে পাকিস্তান কিছু কথা শুনেছেও। এসব গোষ্ঠীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কারাগারে পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরে তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার কথিত মূল পরিকল্পনাকারী পর্যন্ত রয়েছে এই তালিকায়। 

 

 


এদিকে, পাকিস্তান দাবি করে বলেছে যে, এই কাশ্মীর হামলার দায় পাকিস্তানের নয়, বরং তাদের দাবি, স্থানীয় কাশ্মীরিরা এই হামলা চালাতে পারে। ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবাদ করে আসা কাশ্মীরিরাই এ হামলার জন্য দায়ী। এমনকি ইসলামাবাদ এমন দাবিও করেছে যে, পাকিস্তানিরা কাশ্মীরির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে এসেছে। যদিও এমন বক্তব্যের সপক্ষে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি এখন অবধি। 
যাহোক, অচিরেই এ সংঘাত বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে উভয় পক্ষকেই চড়া মূল্য দিতে হবে। যদি বৃহত্তর সংঘাত শুরু হয়, তাহলে উভয় পক্ষের হয়তো অর্থনৈতিক দিক থেকে তেমন একটা অসুবিধায় পড়তে না-ও হতে পারে! কারণ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কার্যত কোনো বাণিজ্য নেই। নয়াদিল্লি সম্ভবত এমন হিসাব করেছে যে, তার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এই সংঘাতের কারণে তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বিদেশিরা বহাল তবিয়তে ভারতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ চালিয়ে যাবে। উপরম্ভ, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সদ্য স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তিও দিল্লির মনে শক্তি জোগাচ্ছে। 
আন্তর্জাতিক সুনাম বা সুখ্যাতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও কোনো পক্ষেরই যেন হারানোর মতো কিছু নেই! অতীতের সংকটগুলোতে দেখা 

 

 

 

 


অতীতে ভারতে যেসব সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, প্রায় প্রতি বারই অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পাকিস্তান থেকে এসেছে বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সরকার এমন অনেক প্রমাণ হাজির করে, যেখানে তাদের দাবি ছিল, বন্দুকধারীরা ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেছিল পাকিস্তানে অবস্থানরত তাদের লোকজনের সঙ্গে। দিল্লি প্রমাণ হাজির করে দেখিয়েছিল, কীভাবে পাকিস্তানের মাটিতে বসে ঐ হামলা পরিচালিত হয়েছিল। তবে এবারকার কাশ্মীর হামলায় এখন পর্যন্ত আমাদের সামনে এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয়, কাশ্মীরে পর্যটক হামলার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত। 

 

গেছে, পশ্চিমা দেশগুলো সামরিক পদক্ষেপের নিন্দ্য ও সমালোচনার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে। তবে এবার বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা! তাদের ভাষ্য, আজকাল 'দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত'কে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবেই দেখা হয় এবং সেক্ষেত্রে দুই পক্ষকে বসে নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে হয়। অর্থাৎ, ভারত ও পাকিস্তানকে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষই সমস্যায় পড়বে। অবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে করে মনে হয়, সামরিক পদক্ষেপ না নিলে নিজের দেশের জনগণের তোপের মুখে পড়বে উভয় সরকার। সহজ করে বললে, সামরিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে উভয় সরকারকেই 'রাজনৈতিক মূল্য' দিতে হতে পারে। 

 

 


২২ এপ্রিল, তথা এই সন্ত্রাসী হামলার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার দাবি করেছিল যে, কাশ্মীরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে এবং সাধারণ ভারতীয়রা নিরাপদে এ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারছে। তবে এই হামলা তার সেই দাবিকে স্বভাবতই দুর্বল করে দিয়েছে। এমন একটি অবস্থায় সরকারের 'প্রতিক্রিয়া জানানো টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

 


ঠিক একইভাবে, ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকার যদি সাড়া না দেয়, তাহলে ক্ষমতাসীন সরকার তো বটেই, বিশেষ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও এর মূল্য দিতে হবে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে। তাদের দাবি, তারা একাই পাকিস্তানি জনগণকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে আসছে। ফলে এখন যদি তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের সেই দাবিটি 'ফাঁকা' মনে হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই 
যাহোক, আশা করা যায় যে, উভয় পক্ষের সীমিত সামরিক পদক্ষেপের পর আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হতে শুরু করবে, যেমনটি আগে লক্ষ করা গেছে একাধিকবার। তবে প্রশ্ন হলো, এবারও যে ঠিক তেমনটাই ঘটবে, তার নিশ্চয়তা কী? 

 

লেখক: গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ: সুমুৎ খান