কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মাখন খাচ্ছে চীন

[সূত্র : কালবেলা, ১১ মে ২০২৫]

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মাখন খাচ্ছে চীন

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, যা চীনের জন্য একটি সম্ভাব্য মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্যের উৎস হয়ে উঠেছে। এ সংঘাতে চীনা যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করছে ইসলামাবাদ। পাশাপাশি এ লড়াই বেইজিংয়ের জন্য হয়ে উঠেছে বাস্তব যুদ্ধের পরীক্ষাগার—বিশ্বে চীনা সামরিক প্রযুক্তির সক্ষমতা কতটা কার্যকর, তা-ও প্রথমবারের মতো পরখ করার সুযোগ পেয়েছে বেইজিং।

 

 

যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সামরিক প্রযুক্তির সক্ষমতা ও দুর্বলতার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে সহায়ক হবে। এর মধ্যে চীনা যুদ্ধবিমান দিয়ে পাকিস্তানে হামলায় ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবরে বেইজিংয়ের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের শেয়ারমূল্য বেড়ে গেছে। আর চীনা প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যও হুহু করে বাড়তে শুরু করেছে।

 

 

নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, চীনের সামরিক আধুনিকীকরণ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা এখন সীমান্ত ঘাঁটি, ভারত মহাসাগরে মোতায়েন নৌবহর এবং মহাকাশ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের পদক্ষেপ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নিল বলেছেন, ‘গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে এটি (ভারত-পাকিস্তান সংঘাত) চীনের জন্য নিজেদের সীমান্ত ঘেঁষে একেবারে অপ্রত্যাশিত এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে তাদের একটি সম্ভাব্য প্রধান প্রতিপক্ষ জড়িত।’

 

 

দুই মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, চীনের তৈরি জে-১০সি নামে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভারতের অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের ওই দুই যুদ্ধবিমানের একটি ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল। ভারত তাদের কোনো যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার কথা এখনো স্বীকার করেনি। তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে-১০সি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করার কথা নিশ্চিত করেছেন; যদিও ভারতের বিরুদ্ধে সংঘাতে কোন কোন ক্ষেপণাস্ত্র বা কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, সে বিষয়ে কিছু জানাননি।

 

 

 

চীনের জন্য বিরল সুযোগ

আকাশযুদ্ধ সব দেশের সামরিক বাহিনীর জন্যই বিরল এক সুযোগ। আকাশযুদ্ধের মাধ্যমে তারা বৈমানিক, যুদ্ধবিমান এবং সক্রিয় যুদ্ধে আকাশ থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র কতটা কার্যকর, তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং সেখান থেকে পাওয়া জ্ঞানের আলোকে নিজেদের বিমানবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।

 
 

প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক পরাশক্তি ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত এবং চীনকে দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হয়। দুই দেশের মধ্যে হিমালয় অঞ্চলে ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে এবং ১৯৬২ সালে চীন ও ভারত একবার সংক্ষিপ্ত সংঘাতে জড়িয়েছিল। চীন-ভারত সীমান্তে সর্বশেষ অচলাবস্থার সূত্রপাত হয়েছিল ২০২০ সালে। ওই অচলাবস্থা কিছুটা প্রশমিত হয় গত অক্টোবর মাসে, যখন উভয় পক্ষ সীমান্তে টহল সংক্রান্ত এক চুক্তিতে পৌঁছায়।

 

 

 

প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় পক্ষই সীমান্তজুড়ে নিজেদের সামরিক স্থাপনা ও সক্ষমতা জোরদার করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও এর বাইরে চীন আকাশ থেকে গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ওপরও অধিক গুরুত্ব দেয়।

 

 

লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চীনের ২৬৭টি স্যাটেলাইট কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি গোয়েন্দা নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আরও ৮১টি সামরিক ইলেকট্রনিক ও সিগন্যাল তথ্য পর্যবেক্ষণ করে। এটি এমন একটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, যা ভারতসহ আঞ্চলিক সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে চীন। এখন সক্ষমতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের অবস্থান।

 

 

হাওয়াই প্যাসিফিক ফোরাম থিঙ্কট্যাঙ্কের সহযোগী গবেষক নিল বলেন, ‘মহাকাশে এবং ক্ষেপণাস্ত্র অনুসরণের ক্ষেত্রে চীন এখন অনেক শক্তিশালী। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেগুলোর ওপর নজরদারি করতে সক্ষম।’

 

 

 

সামরিক স্যাটেলাইট এবং তাদের গোয়েন্দা নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন করতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স থেকে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। চীনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মিডিয়া উইং এবং তথ্যমন্ত্রীও তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। তবে পাকিস্তান এর আগে বলেছিল, চীনের সঙ্গে তাদের একটি ‘সর্বাত্মক কৌশলগত, সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব’ রয়েছে।

 

 

ভারতও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বৃহস্পতিবার স্কাই নিউজকে বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা নেই। দোরাইস্বামী বলেন, ‘চীনের জন্য তার সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন, যার মধ্যে আমরাও অন্তর্ভুক্ত।’

 

 

 

বিশ্ববাজারে চীনা সামরিক প্রযুক্তির প্রভাব বাড়ছে

চীনের তৈরি জে-১০সি আধুনিক অস্ত্র ও এভিয়নিক্সসহ ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচিত, যা রাফায়েলের সমতুল্য। পাকিস্তান ২০২২ সালে প্রথম এই বিমান হাতে পায়। পাকিস্তান তাদের জেএফ-১৭ ব্লক বিমানেও চীনের উন্নত পিএল-১৫ মিসাইল ব্যবহার করছে, যা ২০০-৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়।

 

 

এ ঘটনাগুলো চীনের জন্য একটি ‘শক্তিশালী বিজ্ঞাপন’ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। অনেক দেশ যারা পশ্চিমা প্রযুক্তি কিনতে পারে না বা নিষেধাজ্ঞার মুখে, তারা এখন চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো এর মধ্যে রয়েছে।

 

 

 

ভারতের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা যেমন বেড়েছে, তেমনি পাকিস্তান পুরোপুরি ঝুঁকেছে চীনের দিকে। চীন-পাকিস্তান যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক এখন একটি কৌশলগত জোটে রূপ নিয়েছে। এ সংঘাত যদি দীর্ঘায়িত হয় বা আরও প্রকট আকার ধারণ করে, তাহলে তা চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি নতুন মঞ্চে পরিণত হতে পারে, যেখানে অস্ত্রের কার্যকারিতা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের বাজার ভাগাভাগির নিয়তি।

 

 

জে-১০সি যুদ্ধবিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্য বেড়েছে

সিএনএন বলছে, ঘটনা সত্যি হলে এই প্রথম কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে রাফায়েল সরাসরি ধ্বংস হলো। এ খবরে সেখানে পাকিস্তানের ব্যবহৃত চীনা যুদ্ধবিমান জে-১০সি এবং জেএফ-১৭ তৈরি করা চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের শেয়ারমূল্য ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।