ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েই গেল?
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৮ মে ২০২৫]

চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার উত্তেজনা ভয়াবহ আশঙ্কার দিকে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক রেখা ভঙ্গ করে ভারত পাকিস্তানের মূলভূমিতে আক্রমণ করেছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ভারতের হামলায় শিশুসহ অন্তত ২৬ জন মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। বিপরীতে, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারত-শাসিত কাশ্মীরে অন্তত ১০ জন নিহত এবং ৩২ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। পাকিস্তান আরও দাবি করেছে যে, তারা ভারতের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেছে। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে প্রায়শই উত্তেজনা দেখা দিলেও, ভারত-পাকিস্তানের এই রকম পাল্টাপাল্টি আঘাত বড় ধরনের যুদ্ধ শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, গত মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে ভারত প্রত্যাঘাতের অধিকার প্রয়োগ করেছে। এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্তের ওপার থেকে আরও সম্ভাব্য হামলা ঠেকানোর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদী কাঠামো ধ্বংস করাই এই হামলার উদ্দেশ্য। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত যে প্রত্যাঘাত করেছে, তা পরিমিত, সমানুপাতিক, দায়িত্বশীল ও যা ছড়িয়ে পড়বে না এমন। ভারতের লক্ষ্য ছিল, সন্ত্রাসবাদীদের অবকাঠামো ভেঙে দেওয়া, যাতে সন্ত্রাসীদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাঠানো ঠেকানো যায়।
ভারতীয় সময় গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে এই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনীর দুই নারী কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। ওই দুই কর্মকর্তা দাবি করেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে শুরু করে রাত দেড়টা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপাশে মোট ৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতীয় বাহিনী হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছে। তারা আরও দাবি করেন যে, অপারেশন সিঁদুর কোনো পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করেনি। সাধারণ মানুষকেও নিশানা করা হয়নি। বেছে বেছে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। সোফিয়া ও ব্যোমিকা দাবি করেন, প্রথম লক্ষ্য ছিল ভাওয়ালপুরের মারকাজ শুবহান আল্লাহ।
সেখানে জইশ-এ-মহম্মদের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবির ছিল। বিলাল মসজিদে ছিল লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কোটলিতে যেখানে হামলা হয়েছে, তা লস্করের ঘাঁটি। এসব ঘাঁটি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও হামলা চালিয়েছে জানিয়ে সোফিয়া ও ব্যোমিকা আরও দাবি করেন, শিয়ালকোটের যে সার্জাল ক্যাম্পে হামলা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৬ কিলোমিটার ভেতরে। এ ছাড়া আক্রমণ চালানো হয় মেহমুনা জোয়া ক্যাম্পে। সেটা হিজবুলের শিবির ছিল। এই শিবিরে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরাই পেহেলগামে হামলা চালিয়েছিল। তবে, পাকিস্তানের দাবি ভিন্ন। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতীয় বাহিনীর চালানো হামলা মূলত বেসামরিক এলাকায়ই আঘাত হেনেছে। এর ফলে প্রাণহানি হয়েছে সাধারণ মানুষের। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির দাবি করেছেন, ভারতের সামরিক হামলায় পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৪৬ জন।
অন্যদিকে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার পাকিস্তানের আছে বলে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)। কমিটি বলেছে, ভারতের হামলার জবাবে সময় অনুযায়ী যথাযথ স্থানে পছন্দ মতো প্রতিক্রিয়া জানাবে পাকিস্তান। সামরিক বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুমোদন দিয়েছে পাকিস্তানের নিরাপত্তাবিষয়ক সর্বোচ্চ কমিটি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘ সনদেও ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নিরীহ পাকিস্তানিদের প্রাণহানি এবং তাদের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যে কোনো সময়, স্থান ও পদ্ধতিতে আত্মরক্ষায় প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত মাসের ২২ তারিখ ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের কাছে বৈসরণ উপত্যকার তৃণভূমিতে সশস্ত্র জঙ্গিরা অতর্কিত হামলা চালায়। এর ফলে ২৬ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই পর্যটক।
২০০০ সালের পর থেকে এই আক্রমণটি এমন অঞ্চলে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। ভারত দাবি করে, পাকিস্তান এই জঙ্গিদের মদদ দিয়েছে এবং হামলার পর থেকেই পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য ভারতের অভ্যন্তরে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেদিনের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছিল। ভারত পাকিস্তান থেকে সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের কথা বলে। একই রকম কারণ দেখিয়ে পাকিস্তানের সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক নির্দেশে নিজেদের সমুদ্রবন্দরে ভারতীয় জাহাজ প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ভিসা নিয়ে কাশ্মীরে অবস্থান করছিলেন, তাদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
দুই দেশের মধ্যে এহেন যুদ্ধপরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। আমরা মাত্রই খবর পেলাম। বহু দশক ধরে তারা লড়াই করে আসছে। আমি আশা করি, এটা খুব শিগগিরই শেষ হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ‘আমি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যোগাযোগ রাখছি।’ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেন, ‘দুই পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে। বিশ্ব আরেকটি ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাত সহ্য করতে পারবে না।’ ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ নোয়েল ব্যারেট বলেন, ‘আমরা ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারকে বুঝি, তবে উভয় পক্ষকে সংযম দেখাতে এবং নাগরিকদের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাই।’ জাপানের মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং উভয় দেশকে সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানাই।
’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ সুলতান বলেন, ‘সংঘর্ষ এড়াতে কূটনীতি ও সংলাপই সর্বোত্তম উপায়।’ রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয় দেশকে সংযম দেখাতে আহ্বান জানায় এবং সন্ত্রাসবাদের সব রূপের নিন্দা করে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘ভারতের সামরিক কর্মকাণ্ডে আমরা উদ্বিগ্ন এবং উভয় দেশকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আহ্বান জানাই।’ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার কারণে মালয়েশিয়ায় চাল আমদানি ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটি। চালের সরবরাহের জন্য অন্য বিকল্পের কথাও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তামন্ত্রী মোহাম্মদ সাবু স্থানীয় গণমাধ্যম নিউ স্ট্রেইটস টাইমসকে বলেছেন, ‘এই দেশের আমদানি হওয়া চালের প্রায় ৪০ শতাংশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসে।’ মালয়েশিয়ার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তাদের (ভারত-পাকিস্তানের) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো যুদ্ধ বা উত্তেজনার পরিস্থিতি যদি বন্দরের কর্মকাণ্ড বা সরবরাহ অবকাঠামোকে প্রভাবিত করে, তাহলে আমাদের দেশে চাল আমদানি ব্যাহত হতে পারে।’ ভারত ওই দেশটিতে সাদা চাল সরবরাহ করে। বাসমতি চাল আসে পাকিস্তান থেকে। মালয়েশিয়ার ৩ কোটি ৪০ লাখ বাসিন্দার বেশিরভাগই এর ওপর নির্ভরশীল। মালয়েশিয়ার কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তামন্ত্রী বলেছেন, ‘যদি ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে, বিশেষ করে দাম এবং সরবরাহের ধারাবাহিকতার দিক থেকে।’ যুদ্ধের একটি অবধারিত প্রভাব হচ্ছে অর্থনীতি। বুধবার ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্টে জানানো হয়, হামলার পরপরই এনডিএফ মার্কেটে রুপির মান পড়ে যায় ৮৪.৪৩২৫-এ, যেখানে বিগত এক মাসে তা ৮৪.৬৪ থেকে ৮৪.৬৮ রেঞ্জে লেনদেন হচ্ছিল।
দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিবেশী হিসেবে এই যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতির আশঙ্কায় আছে বাংলাদেশ। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ শীতল। হাসিনাকে সে দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এন্তার অপতথ্য ছড়িয়েছে। তবে, বাংলাদেশের তরফ থেকে দুই দেশকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিরসন করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থানে ফিরে আসবে বলে আশা করি। তিনি আরও বলেছেন, ‘উভয়পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ মনে করে, কূটনৈতিক দিক থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত।’
বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাতে বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। এরপরও বংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ভারতের আকাশপথে কোনো সমস্যা হয় কি না, সেটা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এয়ারলাইনসের বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমা এড়িয়ে চলাচল করছে। বিকল্প রুটে চলাচল করার কারণে বিভিন্ন ফ্লাইটে একটু বেশি সময় লাগছে। বুধবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ বি এম রওশন কবীর এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে পাকিস্তানের আকাশসীমা এড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিমানগুলো। তবে এখনো ভারতের ওপর দিয়ে চলাচল স্বাভাবিক আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, শীতল যুদ্ধের সময় থেকে ম্যাড (মিউচুয়ালি এসিউরড ডেসট্রাকশন) মতবাদে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো বড় আকারের যুদ্ধ থেকে বিরত রয়েছে। তারা এই মতবাদে বিশ্বাস করে যে, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে আক্রমণ করলে উভয়েই সম্পূর্র্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ভয়েই দুই পক্ষ আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। তবে, দুনিয়ার রাজনীতি এখন উত্তপ্ত হয়ে গেছে। লোকরঞ্জনবাদের প্রভাবে অনেক শক্তিধর দেশ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে, উগ্রতার ঢেউয়ে চেপে ক্ষমতা পাওয়ার নেশায় দুনিয়া ধ্বংস করে ফেলতে পারে। তবে আমাদের সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক