ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশা
ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৪ মে ২০২৫]

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর টানা ১৯ দিন ধরে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে এক ধরনের অচলাবস্থা চলছিল। শেষ পর্যন্ত তা হামলা ও পাল্টা হামলায় রূপ নেয়। অবশেষে দেশ দুটি গত ১০ মে ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা থেকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি সম্পন্ন হয়।
বাস্তবিক অর্থে এবারের এই সংঘাতের সূচনার সঙ্গে অতীতের ছোট-বড় নানা সংঘাতের কারণগুলো মোটাদাগে একই রকম। নিকট অতীতে ২০১৬ সালে উড়ি ও ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় পাকিস্তানপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলায় যথাক্রমে ১৯ ও ৪০ জন ভারতীয় সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন। পরে ভারতের পক্ষ থেকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে তার জবাব দেওয়া হয়। পাকিস্তানের দিক থেকে পাল্টা আঘাত না করার কারণে সে সময়ের উত্তেজনা আর বেশিদূর গড়ায়নি।
কথা হচ্ছে, ভারতের ভেতর হামলার ঘটনা এবারই প্রথম নয় এবং এর জবাবে ভারত অতীতে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তার তুলনায় এবারের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারত অনেকটাই জানান দিয়ে তার সমরসজ্জা শুরু করে, যা পাকিস্তানকেও পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করে। ২২ এপ্রিলের পর থেকে দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখায় প্রতি রাতেই ছোট-বড় গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি বদলে যায়, যখন গত ৬ মে মধ্যরাতে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত করে।
আসলে এই যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া ছাড়া কী-ই বা করার ছিল এই দুই পক্ষের। এটা নিয়েও বিস্তর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সর্বাগ্রে এখন যে বিষয়টি বহুল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে এটিকে সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের অবকাশ ছিল। একটি সংঘাতের আপাত অবসান নিশ্চিতভাবেই দুই পক্ষের মধ্যে কিছু ক্রোধকে জিইয়ে রেখেছে। আর এর বড় প্রমাণ হচ্ছে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের রাতেও উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। অর্থাৎ থমকে থমকে এখনো এই অস্থিরতা বিরাজ করছে। সে ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর দুই পক্ষের ওপরই কিছু দায়িত্ব এসে পড়ে। সে দায়িত্বগুলো হচ্ছে, যুদ্ধাবস্থার আগের জায়গায় ফিরে আসা। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থার সংকট রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে দুপক্ষেরই কাজ শুরু করা। সেটা করা না হলে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের সামরিক বাহিনী ক্ষান্ত হলেও অনানুষ্ঠানিক শক্তিগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এখানে আমরা জানি যে ভারতের ভেতর যেমন পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে সদা শঙ্কা রয়েছে, একই রকম বিষয় পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুই দেশেরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নানাভাবে সহযোগিতা বা উসকানি দিয়ে আসছে বলে একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে। দুপক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ২২ এপ্রিলের পর দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেমন সিন্ধুর পানিচুক্তি বাতিল, কূটনীতিকদের বহিষ্কার, বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্থগিতাদেশ, আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া, ভিসা বাতিল ইত্যাদি। এর দুয়েকটি পদক্ষেপের পরিবর্তন হয়েছে। বাকি ক্ষতগুলো মেরামতে দুই পক্ষেরই উদ্যোগ ও সংযত আচরণের প্রয়োজন রয়েছে। সেটা না হলে ধারণা করাই যেতে পারে যে এই যুদ্ধবিরতি একটি আপাত বিরতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং সম্পর্কের এই অচলাবস্থার সুযোগে তৃতীয় পক্ষের উসকানি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলতে পারে।
উপমহাদেশের এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যকার এই তিক্ততার সম্পর্ক ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এবং কাশ্মীরকে নিয়ে সূচনা হলেও বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতি বর্তমানে অন্যতম প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার প্রশমনে শুরু থেকেই বিশ্বসম্প্রদায়ের যে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল, সেটা আমরা দেখতে পাইনি, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের ধরন অনেক ক্ষেত্রেই উত্তেজনাকে উৎসাহ দিয়েছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অপর মিত্র ইসরায়েলের ‘ভারতের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’ মর্মে বক্তব্য, ইসরায়েলের সরবরাহকৃত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভারতকে সেগুলোর ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলে। একইভাবে পাকিস্তানের প্রতি তুরস্ক ও চীনের পরোক্ষ সমর্থন পাকিস্তানকেও ভারতের মোকাবেলায় উৎসাহী করে। পারমাণবিক সক্ষমতার বিষয়টিও পাকিস্তানকে অধিক আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
চীন সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভেবে পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে কোনো বক্তব্য দেওয়া না হলেও সে দেশের গণমাধ্যমগুলো মোদিকে উসকানিদাতা হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তানের জন্য প্রতিরক্ষায় পাল্টা পদক্ষেপকে ‘অপরিহার্য’ বলে উল্লেখ করে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি চীন থেকে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত এস এইচ কামান এবং জে-১০সি জঙ্গিবিমান ব্যবহারের মতো ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের সক্ষমতারও একধরনের পরীক্ষা হয়ে গেল যেন! সেই সঙ্গে চীনের গণমাধ্যম এবং পাকিস্তানের সরকারি পর্যায় থেকে অভিন্ন সুরে বলতে শোনা যায়, ‘পাকিস্তান প্রয়োজনে সব ধরনের শক্তির প্রয়োগ করবে, সেটা হোক সাধারণ বা পারমাণবিক।’ এ সব কিছুই গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। বিষয়টি যেন এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যায় যে এই যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান ছাড়িয়ে আরো বৃহত্তর পর্যায়ে বৈশ্বিক শক্তি কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে উদ্বেগের মূল কারণ এখানেই। বিষয়টিকে আর বাড়তে না দিয়ে তাই এখানেই শেষ করে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে জন্যই এটা একটা আপাত যুদ্ধবিরতি। এখানে অনেক বিষয়ই এখনো অস্পষ্ট। ভারতে মোদি সরকারের দিক থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে সরকারিভাবে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সেটা প্রমাণ করার বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। কিন্তু অতীতে বিভিন্ন সময়ে, যেমন ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে লোকাল ট্রেনে বিস্ফোরণ এবং ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের হোটেলে হামলা, এসবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সরকারের তরফ থেকে এলইটি এবং জইশ-ই-মুহাম্মদের প্রধানদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকারের দিক থেকে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও এখনো অনেকের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রকট যে এই সংগঠনগুলো শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা পরিচালনা থেকেই বিরত থাকছে না, বরং বেলুচিস্তানের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোসহ যারা পাকিস্তানের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি, এরা তাদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছে। এই বিবেচনায় পাকিস্তানের এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে অনেকটা রাশিয়ার ভাড়াটে ‘ভাগনার’ বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নের স্বার্থে পাকিস্তান সরকারের দিক থেকে প্রচেষ্টা আরো কার্যকর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ভারতে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের জন্য একদিক দিয়ে যেমন গোড়া হিন্দুদের দিক থেকে মোদি সরকারের ওপর তাদের ভাষায় পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতার জবাব দেওয়ার চাপ রয়েছে, চাপ রয়েছে সরকারের মূল শরিক দলের পক্ষ থেকেও। আবার কংগ্রেসসহ সরকারবিরোধী দলগুলো এটাকে মোদির ব্যর্থতা হিসেবে প্রচার করতে সচেষ্ট থাকবে। এসব বহুবিধ চাপ থেকে নরেন্দ্র মোদি প্রথম হামলার যে নীতি নিয়েছিলেন, সেটা কিন্তু ভারতের জন্যও খুব একটা সুখকর ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই পক্ষই যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন কোনো অজানা আশঙ্কার তথ্য পেয়েছে, যা তাদের তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
তবে এখানে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট মেরামতে কাজ করা প্রয়োজন। একে অপরের ওপর যে নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছে সেগুলোর প্রত্যাহারসহ প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যস্থতায় দীর্ঘমেয়াদি কিংবা স্থায়ী শান্তির পথ উন্মোচনে কাজ করতে হবে। দুই পক্ষের এই উত্তেজনা থেকে তৃতীয় পক্ষের সুবিধা নেওয়ার আগেই নিজেদের মতো করে সমস্যা মেটানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। আর এটা করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়