কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভারতীয় আগ্রাসন ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা

আজকের বাস্তবতায় প্রতিরক্ষার প্রতিটি উপাদানের দিকে নজর দেয়া জরুরি। সীমান্তের পাহারা কেবল সামরিক সক্ষমতা দিয়ে হবে না, সাংস্কৃতিক সীমান্তও বাঁচাতে হবে। আবার সামরিক সক্ষমতার অনুপস্থিতি আধিপত্যবাদের আগ্রাসনকে প্ররোচিত করবে। সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষা মিলেই একটি রাষ্ট্রের অদৃশ্য অথচ বাস্তব সীমান্ত। যদি রাষ্ট্র এসব সীমান্ত সচেতনভাবে নির্মাণ না করে, তবে প্রতিপক্ষ এগুলো দখল করে নেয়। বাংলাদেশের প্রয়োজন আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে কৌশলগত রূপান্তর মুসা আল হাফিজ [প্রকাশ : নয়াদিগন্ত, ১ জুলাই ২০২৫]

ভারতীয় আগ্রাসন ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা

বাংলাদেশ এক জটিল ভূরাজনৈতিক চক্রব্যূহে অবস্থান করছে। ভারতীয় আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নিরাপত্তা শুধু সামরিক বিষয় নয়, এটি কৌশলগত স্বার্থ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, তথ্য ও নাগরিক চেতনার সমন্বিত একটি ক্ষেত্র। আমরা এখানে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা সমুন্নত করে এমন একটি বাস্তবসম্মত নিরাপত্তা রূপরেখা প্রস্তাব করব।

 
 

 

 
 

১. নিরাপত্তা কাঠামোর পূর্ণ সংস্কার

 
 

 

 

ক. জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। এটি হবে আনুষ্ঠানিক নীতিপত্র, যেখানে রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিরাপত্তা দর্শন সংজ্ঞায়িত হবে। নিরাপত্তা অগ্রাধিকার, কৌশল ও হুমকির বিশ্লেষণ থাকবে। এই নীতিমালা সামরিক নিরাপত্তার নীতি হাজির করবে। একই সাথে সাইবার, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সামগ্রিক কাঠামো উপস্থাপন করবে। এটি এ জন্য জরুরি যে, বাংলাদেশ এখনো অ্যাডহক ভিত্তিতে নিরাপত্তা ইস্যু সামলায়। এখানে কোনো Threat Matrix নেই, যার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে- কে বন্ধু, কে হুমকি ইত্যাদি। এমন একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না। একেক প্রতিষ্ঠান একেকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, যা আরো বিভ্রান্তি তৈরি করে।

 

বস্তুত জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণে একটি core doctrine থাকা জরুরি, যাতে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে। কী থাকবে এই নীতিমালায়? থাকবে- ক. ভারতীয় পানি-নির্ভরতা, সীমান্ত হত্যা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাবের দিকগুলো। খ. ভূখণ্ডের অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার মতো বিষয়। গ. হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার মোকাবেলায় সামরিক ও অ-সামরিক উপায়। ঘ. প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়ন পরিকল্পনা- সেনা, বিমান, নৌ ও সাইবার শক্তির অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য।

 

কারা এটি প্রণয়ন করবে? এটি প্রণয়ন করবে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল- এনএসসি। কিন্তু মুশকিল হলো, এই কাউন্সিল এখনো কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

 

ঙ. আঞ্চলিক ভারসাম্যে কৌশলগত মিত্রতা : চীন, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও মুসলিম বিশ্ব : ভারতের একতরফা ভূ-আগ্রাসন রুখতে বাংলাদেশকে Counterweight Alliances তৈরি করতে হবে। যারা একই সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। চীন ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী, BCIM করিডোরের মাধ্যমে সে এখানকার বাস্তবতায় কৌশলগত প্রভাব রাখে। মালয়েশিয়া গণতন্ত্র ও প্রযুক্তির ভালো মডেল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তার প্রাসঙ্গিকতা এখানেও কাজ করবে। তুরস্ক প্রতিরক্ষা শিল্পে উদীয়মান শক্তি; বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ইরান ভারত-আমেরিকা জোটের বাইরে থাকা একটি বলিষ্ঠ আঞ্চলিক শক্তি। তার সক্ষমতা বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। আন্তর্জাতিক জনমত তৈরিতে মুসলিম জাহান আমাদের কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম।

 

 

কীভাবে এই মিত্রতা গড়া সম্ভব? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। মিত্রতা তৈরি হবে প্রথমত, সামরিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে। যৌথ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ক্রয়, সামরিক প্রযুক্তি স্থানান্তর প্রক্রিয়ায়। চীনের সাথে যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি হতে পারে।

 

 

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক করিডোরের মধ্য দিয়ে। চীন-মালয়েশিয়ার সাথে Special Economic Zone গড়া যায়, রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে।

 

তৃতীয়ত, কূটনৈতিক ফোরাম। UNI OIC-এ একসাথে অবস্থান ও লবিং। ব্রিকসের মতো জোটে জায়গা করে নিতে হবে। আসিয়ানে যুক্ত থাকার উপায় বের করতে হবে।

 

চতুর্থত, মানবিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

 

২. জল-কূটনীতিতে আক্রমণাত্মক উদ্যোগ

 

ক. UN Watercourses Convention-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ : আন্তর্জাতিক নৌ-পথের নন-নেভিগেশনাল ব্যবহারের উপর ১৯৯৭ সালের জাতিসঙ্ঘ সনদ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় ‘ন্যায্য ও যৌক্তিক বণ্টন’ দাবি করে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই কনভেনশনের আইনে আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের নদী-নিয়ন্ত্রণনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। চুক্তিভিত্তিক আন্তর্জাতিক আপিল ও Water Sharing Dispute Tribunal-এ মামলা দায়ের করতে পারে। এতে ভারতের একতরফা প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সাথে নদী ইস্যুকে মানবিক-পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয় হিসেবে তুলে ধরা যাবে।

 

খ. সার্কে মাল্টিলেটারাল চ্যালেঞ্জিং ফ্রেমওয়ার্ক : ভারত দীর্ঘদিন ধরে সার্ককে অকেজো করে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল-ভুটান সম্মিলিতভাবে ভারতের জল-দখলনীতির বিরুদ্ধে কনসোর্টিয়াম তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ পানিবণ্টন ইস্যুকে আঞ্চলিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। সার্ক ওয়াটার কাউন্সিল গঠনের আহ্বান জানাতে পারে। সব দেশ মিলে Equitable River Sharing Protocol গ্রহণ করে ভারতের unilateral action-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান নিতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় একচেটিয়া মাতব্বরি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। নেপাল-ভুটানও সাহস পাবে নিজেদের নদী ইস্যুতে কথা বলতে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা গোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ার পানি সঙ্কটে ভারসাম্যহীনতাকে গুরুত্ব দেবে।

 

৩. সীমানা সুরক্ষা ও নীতিগত প্রতিরোধ

 

ক. সীমান্তে টেকসই টেকনোলজিক্যাল মনিটরিং জরুরি। শুধু বাহিনীর উপস্থিতি সীমান্ত সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়: বরং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর Surveillance Warfare একালে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এখানে ২০০০ সালের পর থেকেই ভারতের নজরদারি ড্রোন, থার্মাল ক্যামেরা, সেন্সর এবং জিও-ট্র্যাকিং ব্যবস্থার আধিপত্য চলছে। অথচ বাংলাদেশ প্রথাগত নিরাপত্তা পদ্ধতিতে আটকে আছে।

 

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী? প্রথমত, ইলেকট্রনিক বর্ডার সিকিউরিটি সিস্টেম (ইবিএসএস) গড়ে তোলা, যা হবে থার্মাল ইমেজিং, নাইট ভিশন ও মুভমেন্ট ডিটেকশন প্রযুক্তিনির্ভর। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বর্ডার কিলিংয়ের ভিডিও প্রমাণ সংরক্ষণের জন্য সীমান্তে দিক-নির্দেশিত ক্যামেরা ও ক্লাউড বেজড স্টোরেজ। তৃতীয়ত, আধুনিক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যা সীমান্তে প্রবেশ, অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও অবৈধ কার্যকলাপ শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়।

 

খ. বিএসএফের প্রতিটি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ‘অ্যাক্টিভ ডিজিটাল প্রোটেস্ট’ জরুরি। প্রয়োজন ডিজিটাল ডিপ্লোম্যাসি ও মিডিয়া অ্যাক্টিভিজম। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়, তার মধ্যে আছেÑ প্রথমত, বিএসএফ কিলিং ডাটাবেজ তৈরি, সংরক্ষণ ও প্রচার। প্রতিটি হত্যার তথ্য, ছবি, ভিডিও ও ভুক্তভোগীর পরিচয় সংরক্ষণ করে বহুভাষিক অনলাইন রিপোর্টিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

 

দ্বিতীয়ত, Real-Time Global Tweetstorm; বিশ্বজুড়ে একই সময়েই, কোনো একটি নির্দিষ্ট ইস্যু, হ্যাশট্যাগ বা বার্তা নিয়ে একসাথে বিপুল পরিমাণে টুইট ছড়িয়ে দেয়া, যেন তা ভাইরাল হয় এবং বিশ্বব্যাপী নজর কাড়ে। প্রতিটি ঘটনার পর নির্দিষ্ট ##Hashtag ও coordinated influencer campaign-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা।

 

তৃতীয়ত, AI-based Narrative Tracker. এ হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সফটওয়্যার বা সিস্টেম, যা অনলাইন, মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কোনো নির্দিষ্ট ন্যারেটিভকে তদন্ত করতে পারে। ন্যারেটিভের গঠন, গতিপ্রবাহ, প্রভাব এবং ছড়ানোর ধরনকে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত, বিশ্লেষণ ও ট্র্যাক করতে পারে। এর মাধ্যমে ভারতীয় মিডিয়ার তথ্যপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে প্রচারযুদ্ধ রুখে দেয়া যাবে।

 

গ. ভারতীয় অনুপ্রবেশ ও হত্যা ইস্যুতে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মামলা। প্রথমত, International Covenant on Civil and Political Rights-(ICCPR) এ বিষয়ে আইনি কাঠামো দেয়। এর ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জেনেভা কনভেনশন-১৯৪৯ এর আইনি অবকাঠামোকে পথ দেখাবে। জেনেভা কনভেনশন হচ্ছে যুদ্ধকালীন সময়ে আহত, অসুস্থ, যুদ্ধবন্দী এবং বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা ও মানবিক আচরণ নিশ্চিতের জন্য গৃহীত আন্তর্জাতিক সনদ। তৃতীয়ত, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন বা Universal Periodic Review (UPR)। যা আমাদের আইনি লড়াইকে সহায়তা দেবে। এসব আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক চুক্তিপত্রের সহায়তা কীভাবে নেবে বাংলাদেশ? প্রথমত, প্রত্যেক বিএসএফ হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ‘Individual Communication’ জমা দেয়া। দ্বিতীয়ত, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে ভারতের ‘Pattern of Abuse’ বা অবিচার বা নিপীড়নের ধারাবাহিক চিত্র জমা দেয়া ও প্রাথমিক আবেদন জানানো। তৃতীয়ত, ওআইসি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে পূর্ণ ডকুমেন্টেড রিপোর্ট প্রদান।

 

এর ফলে ভারত বর্ডার হিউম্যান রাইটসের ভায়োলেটর হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হবে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে অভ্যন্তরীণ ঐক্য গঠন সহজতর হবে।

 

 

৪. অর্থনৈতিক প্রতিরোধ ও শিল্প পুনরুদ্ধার

 

ক. ভারতীয় কোম্পানির একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ বন্ধে অ্যান্টি-ডাম্পিং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। ITC, Godrej, Marico, Bajaj-এর মতো ভারতীয় কোম্পানিগুলো আমাদের বাজারে ডাম্পিং করছে। তারা বাংলাদেশের বাজারে পণ্য বিক্রি করে কম দামে। যাতে স্থানীয় কোম্পানি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে। এর মোকাবেলায় Anti-Dumping Act প্রণয়ন করতে হবে। এ আইন সরকারকে ভারতের বিরুদ্ধে Unfair Trade Practice-এর অভিযোগ তদন্ত ও প্রয়োগের কাঠামো দেবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) পুনর্গঠন এবং তার তদন্ত ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। ডাম্পিং প্রমাণিত হলে ‘কাউন্টারভেলিং ডিউটি’ আরোপ করতে হবে।

 

 

খ. স্থানীয় শিল্পে প্রণোদনা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে রফতানি বিকল্পমুখী সম্পর্ক এবং বহুমুখী প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগকে অধিকতর ক্রিয়াশীল করা। এ ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক, সিরামিক, গার্মেন্টের মতো স্থানীয় শিল্পে সহজ ঋণ, কর ছাড়, রফতানি ভর্তুকি প্রদান ফলপ্রসূ হবে। ভারতনির্ভর আমদানির জায়গায় চীন, থাইল্যান্ড, তুরস্কের মতো বিকল্প উৎস সন্ধান জরুরি। বিমসটেকের মাধ্যমে বাংলাদেশ-নেপাল-শ্রীলঙ্কা-থাইল্যান্ড ট্রেড করিডোর চালু করা যেতে পারে।

 

 

এর ফলে প্রথমত, স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতের বাজার নির্ভরতামুক্ত ও বহুমুখী অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তৃতীয়ত, বিমসটেককে সার্কের তুলনায় একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা যাবে, যেখানে ভারত একক কর্তৃত্ব রাখতে পারবে না। সীমান্ত ও বাজার একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশ যদি তার সীমানা রক্ষা করতে চায় এবং বাজারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে তাকে কেবল প্রতিক্রিয়ায় সীমায়িত হলে চলবে না, প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিস্পর্ধার কৌশলে অভ্যস্ত হতে হবে। এই প্রস্তাবগুলো শুধু তত্ত্বগত নয়; বরং একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রের বাস্তব কর্মপন্থার ফর্মুলা।

 

৫. সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা ও নাগরিক প্রতিরোধ

 

 

ক. ভারতীয় চ্যানেল নিয়ন্ত্রণে কনটেন্ট কোটানীতি চালু করা দরকার : কনটেন্ট কোটা পলিসি হলো এমন একটি আইন বা নীতিমালা, যার মাধ্যমে দেশের মিডিয়া চ্যানেলগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ দেশীয় কনটেন্ট প্রচার বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি তো সত্য যে, ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চরিত্র ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। স্টার জলসা, জি বাংলা ইত্যাদি চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতীয় নারীবাদ, পরিবারব্যবস্থা ও ভাষার কৃত্রিম মানদণ্ড রফতানি হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি Soft Colonialism-এর চেহারা নিচ্ছে।

 

 

এ জন্যই বাংলাদেশকে প্রথমত, কনটেন্ট কোটা অ্যাক্ট প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সব বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও রেডিওতে সর্বনিম্ন ৭০ শতাংশ দেশীয় কনটেন্ট প্রচার বাধ্যতামূলক হবে। ফ্রান্স ও কানাডায় দেশীয় কনটেন্টের জন্য ৬০-৭০ শতাংশ কোটানীতি চালু আছে। এমনকি ভারতও তাদের সংস্কৃতি রক্ষার নামে পাকিস্তানি চ্যানেল নিষিদ্ধ করে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী চ্যানেলের ডাউনলিংকে Delayed Broadcasting চালু করা, যাতে তা সরকার অনুমোদিত কনটেন্ট ফিল্টারের মধ্য দিয়ে সম্প্রচার করে। তৃতীয়ত, সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ব্রডকাস্টিং কমিশনকে একত্র করে মিডিয়া ইন্টিগ্রিটি বোর্ড গঠন।

 

 

খ. জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় শিক্ষাক্রমে সংযুক্ত করা : বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পশ্চিমা ও ভারতীয় প্রভাবের সংমিশ্রণ আছে। স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যের সাথে তার যোগাযোগ কম, বন্ধন একেবারেই দুর্বল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশী মানসিকতা গড়ে না তুললে কী ঘটবে? সবাই জানি, এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে উঠবে সংস্কৃতি-উন্মূল! সাংস্কৃতিক শেকড়চ্যুত প্রজন্ম বিচিত্র প্রবণতার পরাধীনতার জন্য তৈরি থাকে।

 

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমত, জাতীয় পরিচয়-বিষয়ক পাঠ্যসূচির জরুরত। যেখানে সমন্বিতভাবে পড়ানো হবে ঐতিহ্য, ভাষা, আচার, স্বাধীনতার ইতিহাস, প্রেরণার সূত্র ও ক্ষেত্র, ইসলামী সংস্কৃতি ও লোকজ জীবনধারা। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ভারতীয় আধিপত্য সম্পর্কে সচেতনতা এবং উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক প্রতারণার সুনির্দিষ্ট অধ্যায় থাকতে পারে। তৃতীয়ত, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কালচারাল ইন্টেলিজেন্স বা Civic-Identity Literacy নামক নতুন অধ্যায় সংযোজন করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষাকে নিছক আইন বা রাজনীতির বিষয় ভাবলে চলে না; বরং তা এক দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও নৈতিক প্রস্তুতির প্রকল্প।

 

 

৬. কৌশলগত প্রতিরক্ষা দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘমেয়াদে Blue Water Navy গঠনের পরিকল্পনা দরকার। ব্লু ওয়াটার নেভি হবে বিশেষায়িত সমুদ্র-সক্ষম নৌবাহিনী। এই বাহিনী উপকূলের পাশাপাশি মহাসাগরেও কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। যেকোনো মহাসাগরে কাজের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অধিকার করবে এই বাহিনী। এমন বাহিনী দেশের কৌশলগত উচ্চতা ও আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে অবস্থানের প্রতীকে পরিণত হয়।

 

 

অনেকেই বলতে পারেন, বাংলাদেশে এমনটি কেন দরকার? বঙ্গোপসাগর হচ্ছে একটি কৌশলগত অঞ্চল, চীন, ভারত আমেরিকার মতো বিশ্বশক্তির গেটওয়ে। ভারতের আন্দামান-নিকোবর কমান্ড ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করেছে। ভারত লুক ইস্ট নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয়। এর ভিত্তিতে বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্দরে রূপান্তর করতে চাইবে তারা।

 

 

ক. এমতাবস্থায় বাংলাদেশ কী করবে? প্রথমত, ধাপে ধাপে Ocean-Going Submarines, Destroyers, Naval Air Wing গঠনের পরিকল্পনা করবে। দ্বিতীয়ত, Naval War Doctrine প্রণয়ন করবে, যা প্রতিরক্ষার পথরেখা স্পষ্ট রাখবে এবং কৌশলগত deterrence নীতির অংশ হবে। তৃতীয়ত, চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরকে স্ট্র্যাটেজিক নেভাল বেস হিসেবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ যেন বঙ্গোপসাগরে নিরপেক্ষ ও শক্তিমান সমুদ্রশক্তি হয়ে উঠতে পারে, সে দিকে এগোতে হবে। এই সামর্থ্য ভারত, চীন বা অন্য কোনো শক্তির প্রাধান্য অর্জনে বাধা দেবে।

 

 

খ. প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও রাডার সক্ষমতা বাড়াতে চীন ও তুরস্কের সাথে যৌথ উন্নয়ন চুক্তি করা যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশ এখনো প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে নেট ইমপোর্টার। অপর দিকে, ভারতের প্রযুক্তি-নির্ভরতা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক।

 

 

এমতাবস্থায় প্রথমত, চীন-বাংলাদেশ ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে প্রযুক্তি ট্রান্সফার হবে। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের এসেলসান ও বাইরাক্তার কোম্পানির সাথে UAV (ড্রোন), সমুদ্রপৃষ্ঠ রাডার ও কমান্ড-সিস্টেম উন্নয়নে চুক্তি করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি (বিওএফ) পুনর্গঠন করে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেল গঠন করা যেতে পারে।

 

এর ফলে বাহিনীর আত্মনির্ভরতা বাড়বে। ভারত-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ একটি Multi-Vector Defence Partnership Model গড়ে তুলতে পারবে।

 

আজকের বাস্তবতায় প্রতিরক্ষার প্রতিটি উপাদানের দিকে নজর দেয়া জরুরি। সীমান্তের পাহারা কেবল সামরিক সক্ষমতা দিয়ে হবে না, সাংস্কৃতিক সীমান্তও বাঁচাতে হবে। আবার সামরিক সক্ষমতার অনুপস্থিতি আধিপত্যবাদের আগ্রাসনকে প্ররোচিত করবে। সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষা মিলেই একটি রাষ্ট্রের অদৃশ্য অথচ বাস্তব সীমান্ত। যদি রাষ্ট্র এসব সীমান্ত সচেতনভাবে নির্মাণ না করে, তবে প্রতিপক্ষ এগুলো দখল করে নেয়। বাংলাদেশের প্রয়োজন আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে কৌশলগত রূপান্তর।

 

লেখক : কবি, সাহিত্যিক