ভারতের পণ্যে শুল্কের বোঝা, বাংলাদেশের সুবিধা কোথায়
শুভংকর কর্মকার, ঢাকা [প্রকাশ : প্রথম আলো, ০৮ আগস্ট ২০২৫]

দুই সপ্তাহ আগেও পাল্টা শুল্কের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর তৈরি পোশাক রপ্তানির ব্যবসা দখলের ছক কষছিলেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর তুলনামূলক বেশি হারে পাল্টা শুল্ক বসবে; আর তাঁদের পণ্যে শুল্ক কম হবে।
অবশ্য সবকিছু উল্টেপাল্টে গেছে। গত ৩১ জুলাই কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ১৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশের পণ্যের ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেও ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসায় মার্কিন প্রশাসন। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনায় ‘জরিমানা’ হিসেবে গত বুধবার ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতীয় পণ্য প্রবেশে মোট পাল্টা শুল্ক বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলেও ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ বসবে ২১ দিন পর।
এদিকে ভারতীয় পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশের কিছু পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ দেখা দিয়েছে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, উচ্চ শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা বেশ কিছু পণ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবেন। তার মধ্যে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি, আসবাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব পণ্য বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য। ফলে ভারত থেকে সরে আসা মার্কিন ক্রয়াদেশ পেতে পারেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮০ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ২৫৮ কোটি ডলারের ইলেকট্রিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, ৯৩০ কোটি ডলারের জুয়েলারি, ৮৮৭ কোটি ডলারের ওষুধ, ৫১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, ৩৭০ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ১৯৭ কোটি হিমায়িত মাছ ও হিমায়িত চিংড়ি, ৭৫ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য এবং ১১৫ কোটি ডলারের আসবাব ইত্যাদি রয়েছে।
রপ্তানির সুযোগ কোথায়
এনডিটিভির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৫৪০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে ভারত। এই আমদানিতে নিট পোশাকে গড়ে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ ও ওভেন পোশাকে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের দিতে হয়েছে। নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে ভারত থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে গড় শুল্ক ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। এত দিন বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে গড় শুল্ক ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পাল্টা শুল্ক আরোপের পর সেটি এখন বেড়ে হবে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ শুল্ক অপরিবর্তিত থাকলে ভারত থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ সরবে। তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটি হতে পারে।
হোম টেক্সটাইলের ক্রয়াদেশও ভারত থেকে বাংলাদেশ স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর ২৯৩ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করে ভারত। আর বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ১৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল।
এ নিয়ে বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সাবেক চেয়ারম্যান এম শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুল্কের কারণে ভারত থেকে উচ্চ মূল্যের হোম টেক্সটাইল পণ্যের ক্রয়াদেশ সরবে। সেই ক্রয়াদেশ নেওয়ার মতো বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ আছে।’
উচ্চ শুল্কের কারণে ভারত থেকে আসবাবের ক্রয়াদেশও সরবে, যার একটি অংশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওয়ার আশা করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। গত বছর ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ১১৫ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি করেছে। আর বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের আসবাব।
শীর্ষস্থানীয় আসবাব ব্র্যান্ড হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবাবের আরও ক্রয়াদেশ নেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের কয়েকটি কোম্পানির আছে। তবে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে কাঁচামাল আমদানির জন্য বন্ড সুবিধা দিতে হবে।’
অর্থনীতিবিদেরা যা বললেন
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও কাঠামোর পরিপন্থী। রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানি করার কারণে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও ইরান থেকে জ্বালানি কিনলে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসবে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য, তাতে বাংলাদেশও এই হুমকির বাইরে নয়। তা ছাড়া অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করলে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘পাল্টা শুল্কের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহকাঠামো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া পাল্টা শুল্কের সিদ্ধান্ত দ্রুত বদল হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিদেশি ক্রেতারা দ্রুতই ব্যবসা স্থানান্তর করবে, সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। ফলে আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করতে পারি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এখনই ভাবনাচিন্তা করা অনুচিত।’