ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন মেরূকরণ
খন্দকার আপন হোসাইন । সূত্র : শেয়ার বিজ, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে যাচ্ছে। আহমেদ আল-শারা নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আলশাম (এইচটিএস) এবং মাজলুম আবদি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) দল দুটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সিরিয়ার রাজনীতির ৮৫ শতাংশ। বাশার আল আসাদ-পরবর্তী নতুন সিরিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দল দুটির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
সবচেয়ে জটিল সমস্যাযুক্ত বিষয় হলো দল দুটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের সমীকরণ। এই সম্পর্ক সামরিক, জাতিগত, আদর্শগত, আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সম্পর্ক বাশার আল আসাদ বলয়ের বাইরে গিয়ে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কাঠামো গঠনের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বাশার আল আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়ার রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ হয়েছে। কোনো সমাজ বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুটি বিপরীতধর্মী শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাওয়াকে রাজনীতির মেরূকরণ বলে। নতুন সিরিয়ার মেরূকরণকৃত রাজনীতির মধ্যভাগে অবস্থান নেয়ার সুযোগ নেই।
দ্বিধাবিভক্ত সিরিয়া এই মুহূর্তে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে আছে। প্রথম অঞ্চলটির অধীনে রয়েছে দেশটির বৃহত্তর অংশ। বৃহত্তম এই অংশের মূল নেতৃত্বে রয়েছে আহমেদ আল শারা। তার নেতৃত্বাধীন নতুন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ছোট-বড়, অনুগত বা প্রক্রিয়াধীন অনেকগুলো দল। অনুগত এই দলগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে আহমেদ আল শারার নতুন সেনাবাহিনীতে যোগদান করা ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করা।
অপরদিকে সিরিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ জুড়ে বিস্তৃত এর দ্বিতীয় অঞ্চল। দ্বিতীয় অংশের নিয়ন্ত্রণ মাজলুম আবদি পরিচালিত এসডিএফ দলটির ওপর ন্যস্ত। মাজলুম আবদি-নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার দ্বিতীয় অঞ্চলটিতে রয়েছে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন, রয়েছে বিশেষ কাঠামোগত শাসনব্যবস্থা, রয়েছে পানি, তেল, গ্যাস, শস্যসহ সিরিয়ার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সম্পদ। তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চল পর্যন্ত রয়েছে এর সীমান্ত সংযোগ।
সিরিয়ার প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সংবেদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে আহমেদ আল শারা এবং মাজলুম আবদির মধ্যে একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৈঠকটি গোপনে অনুষ্ঠিত হলেও এর বিবরণ এখন প্রকাশ্যে এসেছে। দামেস্কে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটি উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করে। নবগঠিত দামেস্ক প্রশাসনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে সম্প্রতি কিছু তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।
সেই তথ্য থেকে জানা যায়, এসডিএফ নেতা মাজলুম আবদি সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনীতে ৭০ হাজার ৩২১ যোদ্ধাকে সৈনিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে জোর সুপারিশ করেছেন। তবে শর্ত হচ্ছে, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নিয়ন্ত্রণাধীন তুর্কি সদস্যদের আঙ্কারায় হস্তান্তর করতে হবে। কয়েক ডজন চিহ্নিত নন-সিরিয়ান নেতাকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকার-সমর্থিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কুর্দি অধিকারে সম্মত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনকে ভেঙে দিতে হবে, দামেস্কের কৌশলগত সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তুরস্ক ও ইরাকের সঙ্গে সিরিয়ার সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
আলোচিত ও বহুল চর্চিত ওই বৈঠকে কামিশলির প্রতিনিধিদল পাল্টা প্রস্তাব পেশ করেছে। কামিশলি সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হাসাকাহ প্রদেশের একটি শহর। এটি তুরস্ক ও ইরাক সীমান্তের নিকটবর্তী একটি শহর। শহরটিতে মূলত কুর্দি, আরব, আসিরীয় ও আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর বাসস্থান। কামিশলি সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলের (রোজাভা) একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় এটি কুর্দি নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের অধীনে চলে আসে। তবে শহরটির কিছু অংশ সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে।
কামিশলির প্রতিনিধিদলের প্রস্তাব হলো নতুন সিরিয়ান সেনাবাহিনীতে এসডিএফ কেবল সামরিক ব্লক হিসাবে কাজ করবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনের কাঠামো সংরক্ষণ করে এসডিএফ যোদ্ধারা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় তাদের নিজ এলাকায় কাজ করবে। কৌশলগত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ কামিশলির জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। সীমান্তে সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। জাতীয় সংলাপের প্রস্তুতি কমিটিতে কুর্দিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কুর্দিদের অধিকারের সুস্পষ্ট সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রদান করতে হবে।
এসডিএফ নেতা মাজলুম আবদি কিছ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। যেমন সিরিয়ায় নতুন পতাকা উত্তোলন, দামেস্কে বেসামরিক সীমান্ত ক্রসিং হস্তান্তর, কামিশলি ও হাসাকাহতে সরকার নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা স্কোয়ারের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা। সর্বোপরি উভয় পক্ষই দ্বিতীয় দফা বৈঠকের জন্য আলোচনা কমিটি গঠন করতে সম্মত হয়েছে। দামেস্ক ও কামিশলির মধ্যে পশ্চিমা মধ্যস্থতাকারীদের বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়ও প্রকাশ্যে এসেছে।
তবে আলোচনায় প্রত্যেকেই সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা কটিয়ে উন্নয়নকাজে জোর দেয়ার প্রতি ঐকমত্য পোষণ করেছে। কুর্দি নেতা মাসুদ বারজানি তুরস্কের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে মাজলুম আবদিকে দাওয়াত করেন। ইরবিলে মাসুদ বারজানির আতিথ্যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন মাজলুম আবদি। সেই সঙ্গে সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীকে সংগঠিত করা এবং পিকেকে’র সম্প্রসারণ-বিষয়ক আলোচনার জন্য আহ্বান জানান।
হঠাৎ আবার কেন এসডিএফের অবস্থান কঠোর হলো? আলোচনা বৈঠকের মধ্যস্থতাকারীদের কেউ কেউ মনে করেন এইচটিএফের নমনীয়তাই এসডিএফের কঠিন অবস্থানের অন্যতম কারণ। এই পরিবর্তনকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। কামিশলি প্রশাসন প্রদত্ত সংকেত থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার কুর্দি ও এসডিএফকে উসকানি দিচ্ছে। এসডিএফের সামরিক সক্ষমতা, আদর্শিক প্রতিশ্রুতি ও জনগণের প্রত্যাশার পাশাপাশি মাজলুম আবদির একরোখা মনোভাব সিরিয়ার রাজনীতিতে বারবার বৈপরীত্য সৃষ্টি করছে। আবার দামেস্ক বিভিন্ন হিসেবের ওপর নির্ভরশীল বলেও মনে হচ্ছে।
বাশার আল আসাদের পতন ও আইএসআইএসের পরাজয় এসডিএফকে সিরিয়াভিত্তিক রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে দামেস্কের উষ্ণ প্রভাব, পশ্চিমা সমর্থন, বাশার আল-আসাদের পতন পরবর্তী অভ্যন্তরীণ বৈধতা, শক্তিশালী বৌদ্ধিক মতবাদের সঙ্গে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর সামগ্রিক প্রচেষ্টায় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা গেলে খুব দ্রুতই সিরিয়া স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এসডিএফ এরই মধ্যে আবার আরব উপজাতি এবং আরব উপদলগুলোর মধ্যে বৈরী ভাবাপন্ন মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়। এই উপদলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এসডিএফের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। তুরস্ক-সমর্থিত ন্যাশনাল আর্মি সিরিয়ায় কুর্দি সত্তা প্রতিষ্ঠা রোধে কাজ করে। আবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের কুর্দিদের প্রতি মনোভাব কখনও দমনমূলক আবার কখনও কৌশলগত সহযোগিতামূলক। পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী এরদোগানের সিদ্ধান্তের পরিবর্তিত রূপ বিশ্ববাসী দেখেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তার নীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কুর্দিবিরোধী ও সামরিক অভিযাননির্ভর বলেই প্রতীয়মান হয়।
বাশার আল আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। সিরিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইরান, রাশিয়া ও হেজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। বাশার আল আসাদের পতনের পর এই অক্ষের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাশার আল আসাদের পতনের পর দায়িত্বে থাকা দুর্বল সরকারের ব্যর্থতায় আল-কায়েদা বা আইএসের মতো গোষ্ঠীগুলো আবার সক্রিয় হতে পারে। এটি পুরো অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। সিরিয়ার বর্তমান সরকার কার প্রভাবাধীন হচ্ছে, তা নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সামরিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকার ওপর। তবে এটি নিশ্চিত যে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তনের হাওয়া ছড়াচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে আহমেদ আল শারা এবং মাজলুম আবদি দামেস্ক এবং কামিশলির মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। জনসাধারণের হুমকি সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ বিকল্প আলোচনার টেবিলেই রয়ে গেছে। দলভিত্তিক সংলাপের আয়োজন কঠিন হলেও যে কোনো সংলাপে সমাধানের পথ সুগম হয়। সিরিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক ও জাতিগত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করে রাজনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। সিরিয়ার রাজনৈতিক সংকট আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। একজন যত দ্রুত সম্ভব জাতিসংঘ, ন্যাটো, রাশিয়া, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতা করতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কার্যকর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
শিক্ষক
ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল
শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল