কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভূরাজনীতি : চীনা অর্থনীতির লংমার্চ

রানা মিত্তার [সূত্র : প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০২৫]

ভূরাজনীতি : চীনা অর্থনীতির লংমার্চ

আমরা গভীর অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মুক্ত বাণিজ্যের বৈশ্বিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে, যার জায়গা নিচ্ছে শুল্ক বাধা এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা। একই সময়ে, যে যুগে দেশগুলো ক্রমবর্ধমান সম্পদের ওপর নির্ভর করে নাগরিকদের বার্ধক্য ও বেকারত্বের অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করতে পারত, সেই যুগ শেষ হতে চলেছে। কারণ উচ্চতর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা সরকারগুলোকে সম্পদ বরাদ্দের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।

 

 

 
 
 

লক্ষ করার বিষয়, চীন ও চীনা নীতি নিয়ে সমসাময়িক বিতর্কগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের সেই সময়কে খুব কমই স্মরণ করা হয়, যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিআরসি) প্রথমবারের মতো পুঁজিবাদী বিশ্বে প্রবেশ করেছিল। আজকের ভঙ্গুর ভূরাজনৈতিক পরিবেশ গঠনে সেই যুগের ভূমিকা বিবেচনা করলে এটি একটি বিস্ময়কর বিলোপ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট ট্রান্সফরমেশন’ বইয়ে ইতিহাসবিদ ওড আর্নে ওয়েস্টাড এবং চেন জিয়ান দেখিয়েছেন কীভাবে ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশকের মধ্যে চীন একটি কঠোর সোভিয়েত মডেলের কমান্ড অর্থনীতি থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আমূল আত্মনির্ভরশীলতা পেরিয়ে চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের রূপ ধারণ করে।

 

 

 

চীনের রূপান্তর অবশ্য শূন্যে ঘটেনি। ১৯৭০-এর দশক থেকে নব্য উদারবাদ (নিওলিবারেলিজম) অবাধ পুঁজিপ্রবাহ এবং সরকারি হস্তক্ষেপ ও পরিকল্পনা থেকে সরে আসার মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেয়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে চীনের অসাধারণ প্রবৃদ্ধি এ বৈশ্বিক প্রবণতাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, যা তাকে তার বিশাল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে এবং বিশ্বের ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

 

 

অল্প সময়ের মধ্যেই আমেরিকান ভোক্তারা সহজ ঋণে উৎসাহিত হয়ে চীনা-তৈরি পণ্য কেনার জন্য ব্যাপকভাবে ঋণ নেয়া শুরু করে, যা এক গভীর পারস্পরিক নির্ভরতা তৈরি করে। ইতিহাসবিদ নাইল ফার্গুসন ও মরিৎজ শুলারিক যাকে বিখ্যাতভাবে ‘চিমেরিকা’"বলে অভিহিত করেছিলেন। এদিকে ‘শিয়াহাই’ (বাণিজ্যের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়া) শব্দটি চীনে উদ্যোক্তা ঢেউয়ের সংক্ষিপ্ত প্রতীক হয়ে ওঠে, কারণ বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিস্ট দেশটি দ্রুত তার অন্যতম গতিশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পরিণত হয়, যা বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।

 

 

চীনা উদারীকরণের রাজনৈতিক বিপদ: রবার্ট সুয়েটিঙ্গারের ‘দ্য কনসায়েন্স অব দ্য পার্টি’ এবং জোনাথন চ্যাটউইনের ‘দ্য সাউদার্ন ট্যুর’—এই দুটি সাম্প্রতিক বই চীনের ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ যুগের ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন যেসব ব্যক্তি, তাদের ওপর আলোকপাত করে উভয় লেখক স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন কীভাবে স্নায়ুযুদ্ধের শেষ বছরগুলো এবং এর তাৎক্ষণিক পরবর্তী সময়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো আজকের বিশ্বকে প্রভাবিত করে চলেছে।

 

 

সুয়েটিঙ্গার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জেনারেল সেক্রেটারি) হু ইয়াওবাংয়ের গল্প বলেছেন, যার দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থান এখনো অস্পষ্ট। তার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেং শিয়াওপিংয়ের বিপরীতে, যিনি চীনের অর্থনৈতিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত, হু সংস্কার যুগের সরকারি আখ্যান থেকে মূলত অনুপস্থিত। এটাও সত্য তাকে সাবেক সিপিসি সাধারণ সম্পাদক ঝাও জিয়াংয়ের মতো করে হু-কে পুরোপুরি মুছে ফেলা হয়নি। ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্র বিক্ষোভের ওপর সামরিক দমন-পীড়নের বিরোধিতা করার জন্য পদচ্যুত ও গৃহবন্দি হয়েছিলেন ঝাও জিয়াং।

 

 

সংস্কার যুগের বেশির ভাগ সময় ধরে সিপিসির মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী উদারবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন হু ইয়াওবাং। ১৯৮০-এর দশকে তিনি দেং শিয়াওপিংয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেন, যা চীনের রূপান্তর সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে। স্টিমসন সেন্টারের একজন সিনিয়র উপদেষ্টা সুয়েটিঙ্গার, অভ্যন্তরীণ পার্টি নথিসহ বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে—যা এখন আর প্রকাশ্যে পাওয়া যায় না—হু-কে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব-পরবর্তী নবায়নের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে একটি চিন্তাশীল ও গভীর গবেষণামূলক জীবনী তৈরি করেছেন।

 

 

হুনানের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া হু অল্প বয়সেই কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত হন এবং ১৯৩৪-৩৫ সালের লংমার্চে কনিষ্ঠতম অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন। তবে যে কষ্ট তিনি সহ্য করেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে তাকে রাজনৈতিক উগ্রবাদের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে প্ররোচিত করে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাকে কথিত রাজনৈতিক অপরাধের জন্য নিন্দা করা হয়, কাঠের কলার পরিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরানো হয় এবং গ্রামাঞ্চলে বহু বছর ধরে কায়িক শ্রম করতে বাধ্য করা হয়।

 

 

এ ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো, যা হু-কে বেলাগাম কর্তৃত্ববাদের প্রতি গভীরভাবে সন্দিহান করে তুলেছিল বলে মনে হয়, তাকে দেংয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্রও করে তোলে। দেং ১৯৭৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং মাও-পরবর্তী চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রধান স্থপতি হিসেবে আবির্ভূত হন।

 

 

চীনের নতুন পথে যাত্রায় হু-এর প্রভাব ছিল অপরিসীম। ওয়ান লির মতো সংস্কারপন্থী সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে, তিনি সংস্কার যুগের সবচেয়ে প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলোর একটি, অর্থাৎ কৃষি সমবায় ভাঙায় নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেন। ১৯৮০-৮৪ সালের মধ্যে হু হাজার হাজার যৌথ খামার ভেঙে দেয়া এবং পরিবারভিত্তিক কৃষির পুনরায় প্রচলন তত্ত্বাবধান করেন।

 

 

সুয়েটিঙ্গার ফুটিয়ে তুলেছেন কী কারণে হু অসাধারণ ছিলেন এবং কেন শেষ পর্যন্ত তিনি সিপিসি নেতৃত্বের অনেক সহকর্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার কাছে সংস্কারের অর্থ ছিল এটা স্বীকার করা যে কিছু ভুল হয়েছে এবং তা পরিবর্তন করা দরকার। প্রশ্নবিদ্ধ সেই ‘কিছু’ কেবল অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স ও প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু ছিল।

 

 

তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় হু ইয়াওবাং-ই একমাত্র সিপিসি নেতা ছিলেন না যিনি দুর্ভোগ পোহান। উদাহরণস্বরূপ দেংকে নির্বাসিত করা হয়েছিল এবং তার এক পুত্রকে রেড গার্ডরা জানালা থেকে ফেলে দেয়ার পর পঙ্গু হয়ে যান। কিন্তু হু কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় দৃঢ় বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন এবং একই সঙ্গে এর মধ্যে দুর্ভোগের প্রতি একটি ভিন্ন, আরো মানবিক বোঝাপড়া অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।

 

 

১৯৮১ সালে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে, যখন হু-কে পার্টির ইতিহাসের ওপর একটি রেজল্যুশনের খসড়া তৈরির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। রেজল্যুশন অন দ্য হিস্ট্রি অব দ্য পার্টির মতো নিরীহ শিরোনাম সত্ত্বেও নথিটি একটি প্রধান মতাদর্শিক উদ্যোগ ছিল। যা একটি রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করেছিল: সিপিসি কীভাবে গণপ্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মাওয়ের উত্তরাধিকারকে ধ্বংস না করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে নিন্দা করতে পারে?

 

 

হু ইয়াওবাং আরো রেডিক্যাল হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, যদিও তার প্রস্তাবগুলোর বিস্তারিত অস্পষ্ট। আমরা যা জানি তা হলো হু-এর ধারণা দেংকে বিচলিত করে তুলেছিল, যিনি তাকে খসড়া কমিটি থেকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দেন এবং প্রকল্পটি দেং লিকুন ও হু চিয়াওমুর মতো আরো মতাদর্শিকভাবে গোঁড়া ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেন। হু-কে ততদিনে শানডং প্রদেশের দর্শনীয় মাউন্ট তাইয়ে বাধ্যতামূলক বিশ্রামে"পাঠানো হয়।

 

 

চূড়ান্ত বিভেদ আসে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে। দেং এবং তার মিত্ররা একটি সভায় হু-কে অতর্কিত আক্রমণ করেন, যেখানে তার উদারপন্থী প্রবণতা এবং আনুগত্য একটি নিরলস, সুপরিকল্পিত আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। একজন সমালোচক, দেং লিকুন, ৬ ঘণ্টা ধরে কথা বলেন, হু-এর বিরুদ্ধে তার অসংখ্য অভিযোগ তুলে ধরেন। প্রায় ৫০ জন সিনিয়র সিপিসি কর্মকর্তা তাকে ঘিরে ধরেন এবং হু-এর পরবর্তী বর্ণনা অনুযায়ী, তাকে অপমানিত ও সমালোচিত করার চেষ্টা করেন যতক্ষণ না লজ্জায় মাটিতে মিশে যান।

 

 

দেংয়ের সংস্কার কার্যক্রম পুনরায় শুরু: ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে হু-এর মৃত্যু ছাত্র ও শ্রমিক বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা ৩-৪ জুন রাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ার হত্যাকাণ্ডে শেষ হয়। তবে এ ভয়াবহ ঘটনাগুলো শেষ পর্যন্ত সিপিসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। পরবর্তী বছরগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ে, কারণ চেন ইউনের মতো ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে একটি অংশ যুক্তি দেয় যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদারীকরণের সমন্বয় চীনকে বিপন্ন করেছে।

 

 

তবে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে দেং বুঝতে পারেন যে বাজার সংস্কার থেকে এ পশ্চাদপমন স্থায়ী হতে পারে। চ্যাটউইনের আকর্ষণীয় ‘দ্য সাউদার্ন ট্যুর’ বইটি তুলে ধরেছে কীভাবে তিনি পার্টির আরো গোঁড়া অংশগুলোর বিরুদ্ধে পাল্টা চাপ সৃষ্টি করেন। সুয়েটিঙ্গারের বইয়ের চেয়ে ছোট হলেও, এটি সমানভাবে কঠোর।

 

 

চ্যাটউইন ১৯৮৯-৯২ সময়কালের তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে তার বিশাল কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও দেংকে অর্থনৈতিক সংস্কার পুনরায় শুরু করতে কঠোর চাপ দিতে হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি এবং তার সমর্থকরা শেনঝেনের মতো সংস্কার কেন্দ্রগুলোয় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে একটি উচ্চ পর্যায়ের সফর আয়োজন করেন। হংকংয়ের কাছাকাছি এ জায়গা ছিল জেলেদের গ্রাম। যা দ্রুত চীনের একটি প্রধান শহর এবং পুঁজিবাদী উচ্ছ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

 

 

মঞ্চের নেপথ্যের ঘটনাগুলো ছিল আরো তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে, ম্যাকাওয়ের কাছাকাছি শহর ঝুহাইতে, একটি আধুনিক ঘুরন্ত রেস্তোরাঁয় চীনের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের কাছে দেং একটি ব্যক্তিগত ভাষণ দেন। তিনি বলে বসেন, সংস্কারের বিরুদ্ধে যে-ই যাবে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।"এ বিবৃতি স্পষ্ট করে দেয় যে সামরিক বাহিনী তার সংস্কার এজেন্ডাকে সমর্থন করে। এটি সমাবেশে অনুপস্থিত সিপিসি জেনারেল সেক্রেটারি জিয়াং জেমিনের প্রতি একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তাও ছিল।

 

 

যদিও জিয়াং নামমাত্র চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন, দেংয়ের এ ভাষণে তাকে এবং অন্যদের বোঝানোর উদ্দেশ্য ছিল যে সংস্কারের পথ থেকে কোনো পশ্চাদপসরণ তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটাতে পারে। বেইজিংয়ের এলিট রাজনীতির গভীরতম বিবরণ সম্পর্কে আজ খুব কমই জানা যায়, তবে বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর অনুপস্থিতিতে এমন একটি বৈঠক আজও হতে পারত কিনা, তা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।

 

বিলীয়মান উদারনৈতিক ঐকমত্য: সুয়েটিঙ্গার ও চ্যাটউইনের চমৎকার বইগুলো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে তুলে ধরে, যা সম্ভবত ২০০৮ সালে শেষ হয়েছিল, যখন বিশ্ব আর্থিক সংকট বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করে। কিন্তু সেই যুগকে সংজ্ঞায়িত করা পছন্দগুলো আজও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে।

 

আজকের অনেক আমেরিকান নীতিনির্ধারকের দৃষ্টিকোণ থেকে, চীনের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুনরায় একীভূতকরণে মার্কিন সমর্থন—বিশেষ করে ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় তার যোগদান—সম্ভবত একটি কৌশলগত ভুল ছিল, যা চীনকে একটি সমকক্ষ প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম করেছে। তবে অন্যান্য কারণও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, চীনের অর্থনৈতিক উত্থানে আমেরিকার সমর্থন আংশিকভাবে একটি প্রায়ই উপেক্ষিত ভূরাজনৈতিক আবশ্যকতা দ্বারা চালিত হয়েছিল: সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা।

 

সুয়েটিঙ্গার হু-এর অভ্যন্তরীণ নীতিগুলোর ওপর বেশি মনোযোগ দিলেও তিনি হু-কে সিপিসির মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি বৃহত্তর উন্মুক্ততার একজন মূল প্রবক্তা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। যদি ভিন্ন কোনো দল ক্ষমতায় আসত, তাহলে চীন হয়তো আরো পশ্চিমাভিত্তিক পথ অনুসরণ করত।

 

 

দেং যেটাকে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ" বলেছিলেন, তাতে আমেরিকার সমর্থনের পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে ঋণ ইস্যু করে যা চীনা পণ্যের চাহিদা বাড়ায়। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে চীন কুখ্যাতভাবে শিল্প গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত ছিল, যখন তার অর্থনৈতিক লাভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশীয় উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ব্যয় করে। যুক্তরাষ্ট্রও আরঅ্যান্ডডিতে অনুরূপ বিনিয়োগ করতে পারত কিন্তু করেনি।

 

পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পক্ষের প্রধান চরিত্রগুলো ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা উদার নিয়মাবলি থেকে সরে আসছেন বলে মনে হচ্ছে। ২০২১ সালে চীন দ্বৈত সঞ্চালন কৌশল গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং তার অর্থনীতিকে যতটা সম্ভব স্বাবলম্বী করা।

 

প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনা আমদানির ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যার অনেকগুলো তার উত্তরসূরি জো বাইডেন ধরে রেখেছিলেন এবং পরিমার্জন করেছিলেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসন আরো আমূল পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা কেবল চীন নয়, বিশ্বের বাকি অংশকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। অবশ্যই, তার অনেক নীতির মতোই, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যসহ ট্রাম্পের বাণিজ্যিক নীতিও অপ্রত্যাশিত রয়ে গেছে।

 

 

এ ঘটনাগুলো কি হু বা দেং-কে স্তম্ভিত করত? সুয়েটিঙ্গারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, হু উদার অর্থনৈতিক সংস্কার এবং একটি আরো উদার সমাজের মধ্যে স্পষ্ট যোগসূত্র দেখেছিলেন। শির অধীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্রমাগত ক্ষয় তাকে অবশ্যই উদ্বিগ্ন করত। যদিও আজকের চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ের মতো দমনমূলক নয়, সিপিসি নেতারা তৃণমূল থেকে বিপ্লব উসকে দিতে বা দলের কাঠামো উল্টে দিতে চান এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। হু মূল অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে বিতর্ক ধামাচাপা দেয়ার বিপদ উপলব্ধি করতেন।

 

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেং কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন তা মূল্যায়ন করা আরো জটিল। ১৯৮৯ সালের ছাত্র বিক্ষোভের ওপর তার কঠোর দমন-পীড়ন দেখিয়েছিল যে তিনি অর্থনৈতিক উদারীকরণকে রাজনৈতিক বহুত্ববাদের দিকে নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু বাজার সংস্কার পুনরুজ্জীবিত করার তার দৃঢ় প্রচেষ্টা ইঙ্গিত করে যে তিনি বিশ্বাস করতেন চীনের ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক অর্থনীতি তার পূর্ণ একীভূতকরণের ওপর নির্ভর করে।

 

কিন্তু সেই বৈশ্বিক অর্থনীতি আর নেই। একটি একক উদার হেজেমনির অনুপস্থিতিতে—যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-পরবর্তী বেশির ভাগ সময় ধরে ছিল—বিশ্ব জাতীয়তাবাদ, সংরক্ষণবাদ ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদিও এ পরিবর্তন চীনে যতটা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করা হয় তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি, উভয় দেশের নীতিই বৈশ্বিক নিয়মাবলির একটি বৃহত্তর, সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী বিচ্যুতিকে প্রতিফলিত করে।

 

এর বিপরীতে, হু ও দেং-এর দ্বারা চ্যাম্পিয়ন করা উদার সংস্কারগুলো এমন এক যুগচেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল যা একটি আরো উন্মুক্ত বিশ্বকে অনিবার্য বলে মনে করেছিল। উদীয়মান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে একটি বন্ধ ব্যবস্থা বলে ঘোষণা করা খুব তাড়াতাড়ি হতে পারে, তবে ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ দ্বারা উদ্ভূত ঘটনা ও উত্তেজনাগুলো একটি সিদ্ধান্তমূলক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের দিকে নির্দেশ করে। এ অর্থে সুয়েটিঙ্গার ও চ্যাটউইন উভয়ই যে সময়কালটি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা একটি সুদূর অতীত যুগের মতো মনে হয়।

 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

রানা মিত্তার: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ইউএস-এশিয়া রিলেশনসের চেয়ার। ‘চায়না’স গুড ওয়ার: হাউ ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু ইজ শেপিং আ নিউ ন্যাশনালিজম’ (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২০) গ্রন্থের রচয়িতা