কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভূরাজনীতি : মার্কিন সফট পাওয়ারের ভবিষ্যৎ কোন দিকে

জোসেফ এস নাই জুনিয়র [সূত্র : বণিক বার্তা, ২১ মে ২০২৫]

ভূরাজনীতি : মার্কিন সফট পাওয়ারের ভবিষ্যৎ কোন দিকে

ক্ষমতা মানে হলো অন্যদের দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিয়ে নেয়ার দক্ষতা। এটি আদায় করা যায় বলপ্রয়োগ (লাঠির জোর), লোভ (মুলো ঝুলিয়ে দেয়া) বা আকর্ষণ (মধু) দিয়ে। প্রথম দুটি পদ্ধতি পেশিশক্তির (হার্ড পাওয়ার) আওতায় পড়ে, আর আকর্ষণকে বলা হয় সফট পাওয়ার। সফট পাওয়ার জন্ম নেয় একটি দেশের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভিত্তি করে। স্বল্পমেয়াদে পেশিশক্তি সাধারণত সফট পাওয়ারকে ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সফট পাওয়ারই অনেক সময় বিজয়ী হয়। একসময় জোসেফ স্তালিন ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘পোপের কতটা ডিভিশন আছে?’ অথচ আজও পোপ পদ টিকে আছে, কিন্তু স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত।

 

 

 

যখন আপনি নিজেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেন, তখন আর জবরদস্তি বা প্রলোভনের ওপর অতটা নির্ভর করতে হয় না। মিত্ররা আপনাকে সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে দেখলে তারা সহজেই আপনার নেতৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু যদি তারা আপনাকে একতরফাভাবে চাপ প্রয়োগকারী বা অবিশ্বস্ত মনে করে তাহলে তারা হয়তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং নিজেদের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেবে।

 

 

 

স্নায়ুযুদ্ধের ইউরোপ ছিল এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এক নরওয়েজিয়ান ইতিহাসবিদ বলেছিলেন, ইউরোপ ছিল মূলত সোভিয়েত ও আমেরিকান দুই সাম্রাজ্যে বিভক্ত। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে আমেরিকান পক্ষটি ছিল ‘আমন্ত্রণমূলক সাম্রাজ্য’। এর প্রমাণ মিলেছিল ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ও ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে সোভিয়েত বাহিনীকে পাঠানোর সময়। অথচ ন্যাটো টিকে গেছে এবং সদস্য দেশগুলো স্বেচ্ছায় এতে যোগ দিয়েছে।

 
 
 
 

ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে হার্ড ও সফট উভয় দিকই বুঝতে হবে। ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন, একজন প্রিন্সের জন্য ভালোবাসা নয়, বেশি দরকার মানুষের ভয়। কিন্তু বাস্তবে, সবচেয়ে ভালো হয় যদি দুটোই পাওয়া যায়। কারণ শুধু সফট পাওয়ার অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট হয় না এবং এর প্রভাব পড়তেও সময় লাগে। এ কারণে রাজনীতিকরা অনেক সময় হার্ড পাওয়ার ব্যবহারেই বেশি আগ্রহী হন। তবে শুধুই হার্ড পাওয়ার প্রয়োগ করলে তার খরচ অনেক বেশি হয়ে যেতে পারে, যদি না সফট পাওয়ারের সঙ্গে তা যুক্ত করা হয়। বার্লিন ওয়াল ধ্বংস হয়েছিল কোনো কামানের গোলায় নয়, বরং সেই জনগণের হাতুড়ি ও বুলডোজার দিয়ে, যারা কমিউনিজমে আস্থা হারিয়ে পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

 

 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ছিল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। তারা ‘লিবারাল ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার’ নামে একটি গঠনমূলক ব্যবস্থায় তাদের মূল্যবোধ যুক্ত করতে চেয়েছিল। এ ব্যবস্থার অংশ ছিল জাতিসংঘ, ব্রেটন উডস অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় তার উদারনৈতিক মূল্যবোধ পালন করেনি এবং স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিমেরুতা ওই ব্যবস্থাকে বিশ্বের অর্ধেকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদি অক্ষশক্তি জয়ী হতো, তাহলে যে বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম হতো তার চেয়ে এ ব্যবস্থা অনেক ভালো ছিল।

 

 

 

পূর্ববর্তী অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কখনো কখনো এ উদারনৈতিক ব্যবস্থার কিছু দিক লঙ্ঘন করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি সফট পাওয়ারের গুরুত্বই অস্বীকার করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে অফিসে ফিরে আসার পর তার প্রথম কাজগুলোর মধ্যেই ছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে যাওয়া। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারীর ঝুঁকি অত্যন্ত বাস্তব ও ভয়াবহ।

 

 

 

যুক্তরাষ্ট্র সফট পাওয়ারকে উপেক্ষা করলে তার ফলাফল খুবই অনুমেয়। গণতান্ত্রিক মিত্র যেমন ডেনমার্ক বা কানাডার ওপর চাপ সৃষ্টি করলে মিত্রতার ভিত্তিতে আস্থা কমে যায়। পানামাকে হুমকি দিলে লাতিন আমেরিকাজুড়ে ঔপনিবেশিক স্মৃতি আবারো জেগে ওঠে। জন এফ কেনেডির হাতে প্রতিষ্ঠিত ইউএসএআইডির কার্যক্রম অকার্যকর করে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের উদার দানশীলতার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধ করে দিলে কর্তৃত্ববাদী প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে বাড়তি সুযোগ তুলে দেয়া হয়। বন্ধু দেশগুলোর ওপর শুল্ক বসালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৃষ্টি হয় আস্থার সংকট। দেশের ভেতর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। এ তালিকা হতে পারে আরো দীর্ঘ।

 

 

 

ট্রাম্প চীনকে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং চীন ২০০৭ সাল থেকেই সফট পাওয়ারে বিনিয়োগ করে আসছে। সে বছর তৎকালীন চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও কমিউনিস্ট পার্টিকে বলেন, ‘চীনকে অন্যদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। তবে সফট পাওয়ার বাড়াতে চীনের সামনে দুটি বড় বাধা—এক. তাদের বহু প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ; দুই. তারা নাগরিক সমাজের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। জনমত জরিপে এ দুই কারণে চীনের আকর্ষণ কমে গেছে। তবে যদি ট্রাম্প আমেরিকান সফট পাওয়ারকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেন, তাহলে আগামী বছরগুলোর জরিপে কী ফলাফল আসবে তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

 

 

 

নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমেরিকান সফট পাওয়ার সবসময় সমান ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধের সময় বহু দেশে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল। তবে সফট পাওয়ার কেবল সরকার পরিচালিত কর্মসূচি থেকেই আসে না, তা আসে দেশটির সমাজ ও সংস্কৃতি থেকেও। এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও যখন বিশ্বজুড়ে লোকজন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মিছিলে অংশ নিচ্ছিল, তখন তারা গাইছিল আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। প্রতিবাদের সুযোগ থাকা একটি খোলামেলা সমাজও সফট পাওয়ারের সম্পদ হতে পারে। কিন্তু আগামী চার বছরে যদি মার্কিন সরকারের সফট পাওয়ারের যাত্রা হয় অবনতির দিকে তবে সমাজের সাংস্কৃতিক সফট পাওয়ার কি টিকে থাকতে পারবে?

 

 

 

মার্কিন গণতন্ত্র হয়তো ট্রাম্পের চার বছর পার করে উঠতে পারবে। দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতি যথেষ্ট দৃঢ় এবং সাংবিধানিক কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী। ২০২৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারে—এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। তাছাড়া সুশীল সমাজ এখনো শক্তিশালী এবং আদালতগুলো স্বাধীন। বহু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মার্কিন বাজারও ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির প্রতি জানিয়েছে অসন্তোষ।

 

 

 

ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধের সময় তলানিতে গিয়ে ঠেকা আমেরিকান সফট পাওয়ার তার অবস্থান ফিরে পেয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও সফট পাওয়ারের যে নিম্নমুখী অবস্থান তৈরি হয়েছিল সেটাও কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবে একবার বিশ্বাস হারিয়ে ফেললে তা পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়া তার অনেকটা সফট পাওয়ারই হারিয়েছে। আর চীন এখন ট্রাম্পের সৃষ্টি করা শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভাষ্য—‘পূর্ব উঠে আসছে, পশ্চিম ডুবছে।‘

 

 

 

ট্রাম্প যদি মনে করেন তিনি মিত্রদের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে ইউএসএআইডিকে ধ্বংস ও ভয়েস অব আমেরিকাকে স্তব্ধ করে দেশে আইনের শাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন, তাহলে তিনি সম্ভবত ব্যর্থ হবেন। তিনি যা ধ্বংস করছেন তা পুনরুদ্ধার অসম্ভব নয়, কিন্তু তা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

 

 

 

জোসেফ এস নাই জুনিয়র: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ডিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব ডিফেন্স

ভাষান্তর: মঞ্জুরুল ইকরাম