ইয়েমেনে মার্কিন সামরিক হামলা ও এর পরিণতি
সুমন আমীন । সূত্র : সময়ের আলো, ১৯ মার্চ ২০২৫

পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়ে ইয়েমেনে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথিদের ওপর সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী ও শিশু রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাসী যুদ্ধাতঙ্কে দিন কাটাতে শুরু করে।
কারণ ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতেই আমেরিকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার উগ্র মনোভাব প্রকাশ করে আসছিলেন। তার মূল নির্বাচনি সেøাগানই ছিল ‘মেক আমেরিকা ফাস্ট এগেইন’। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা যা করার দরকার তা করতেও তিনি পিছপা হবেন না বলেই মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্যেও এর প্রতিচিত্র ফুটে ওঠে। আরেক পরাশক্তি রাশিয়ার সঙ্গে দ্রুত আপসরফার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এমনকি যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে কূটনীতিবহির্ভূত ভাষায় শাসিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। কট্টর ইহুদিবাদী বর্তমান মার্কিন প্রশাসন ইসরাইলের নিরাপত্তা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক স্বার্থে ইহুদিবিরোধী আরব দেশগুলোকে শায়েস্তা করতে বদ্ধপরিকর বলে ভাবাই যায়।
কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য দেশগুলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রধান হুমকি বলে মনে করে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করার জন্য তাদের সামরিক জোট ন্যাটোকেও প্রস্তুত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য দেশগুলো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আকস্মিক পতনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেওয়ার মতো আর কোনো শক্তি রইল না পৃথিবীতে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক নেতা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। অর্থনৈতিক অসামর্থ্যরে কারণে এতদিন তারা হয়তো সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বৃহৎ সামরিক শক্তির অধিকারী রাশিয়া সময়ের অপেক্ষাতে ছিল।
মার্কিনবিরোধী অন্যতম শক্তি চীন অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে আজ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে শুরু করে দিয়েছে। একই সঙ্গে পৃথিবীর দেশে দেশে বিনিয়োগ ও সামরিক জোট করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একমুখী বিশ্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড় করিয়েছে। তাই তো বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন এবং রাশিয়াকে না ক্ষ্যাপিয়ে পৃথিবীকে শাসন করার ছক কষছে। এর জন্য যদি চীন তাইওয়ানকে এবং রাশিয়া ইউক্রেনকে দখল করে নিজ দেশভুক্ত করে নেয় তাতেও আমেরিকা কোনো পরোয়া করবে বলে মনে হয় না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভেবে থাকতে পারে, তাইওয়ানে চীনকে এবং ইউক্রেনে রাশিয়াকে সুযোগ দিলে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপে এই দেশ দুটি নির্বিকার থাকবে। এ যেন পৃথিবী লুটপাটের এক অদৃশ্য আপসরফা। আমেরিকার অস্ত্র ও অর্থের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এজেন্ট ইসরাইল ইতিমধ্যে প্রায় দেড় বছরের অন্যায় ও অসম যুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।
আরব বিশ্বে ফিলিস্তিনের পক্ষের সক্রিয় ও সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র ও সংগঠনকে এবার নির্মূল করতে তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী মিশন সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এবং হামাসকে যারা সহযোগিতা করে আসছে তারা উভয়ই মার্কিন ও ইসরাইলের অভিন্ন শত্রু। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পৃথিবী জানে গাজায় হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার বাসার আল-আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীসহ মধ্যপ্রাচ্যে যারাই আজ ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকির কারণ তাদের পেছনের মূল খেলোয়াড় ইরান।
গত দেড় বছর সময় ধরে চলমান যুদ্ধে ইসরাইল এরই মধ্যে হামাস এবং হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি করে ছেড়েছে। সংগঠন দুটির মূল নেতাসহ হাজার হাজার সদস্যদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে ইহুদিবাদী দেশটি। আর সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অতর্কিত আক্রমণে ইতিমধ্যে দেশটির ইরানপন্থি প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ পালিয়ে রাশিয়ায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার পরপরই ইসরাইলের সামরিক বাহিনী সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
গাজা, লেবানন এবং সিরিয়া- এই তিন ফ্রন্টে ইসরাইলের বিজয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোকে নতুন করে স্বপ্নের হাতছানি দিচ্ছে। এবার ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ইয়েমেনের হুথিদের ধ্বংসের মাধ্যমে তারা কি ইরানকে পরবর্তী টার্গেট করতে চাচ্ছে? ইয়েমেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতর্কিত হামলা এই সম্ভাবনাকেই যেন জাগিয়ে তোলে। ইয়েমেনে হামলার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘ইরানের অর্থায়নে হুথিরা যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। আমাদের সেনা আর মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। তাদের (হুথি) জলদস্যুতা, সহিংসতা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
ইরানকে জড়িয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাবে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন ইসলামী বিপ্লবী গার্ড প্রধান হোসেন সালামি। তিনি বলেন, ইরানের ওপর যদি কোনো হামলা হয় তা হলে কঠোর ও তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া হবে। ইরান যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু যদি কোনো হুমকি দেয়, তা হলে যথাযথ, কঠোর ও চূড়ান্ত জবাব দেওয়া হবে। হুথি বিদ্রোহীরাও মার্কিন হামলার জবাবে লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএস হ্যারি এস ট্রুম্যান এবং যুদ্ধ জাহাজে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে হামলা করেছে। হুথিরা গাজা থেকে ইসরাইলের অবরোধ তুলে নেওয়া না পর্যন্ত লোহিত সাগরে মার্কিন ও ইসরাইলের জাহাজগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করে যাবে বলে জানিয়েছে। ইরান সমর্থিত এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইসরাইলকে নিজেদের শত্রু মনে করে।
নব্বইয়ের দশকের দিকে শিয়া ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন নিয়ে হুথিরা একত্রিত হয়। ২০০৩ সালে লেবাননের শিয়াপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হুথিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ২০০৩ সালে হুথিদের স্লোগান ছিল : আল্লাহ সর্বশক্তিমান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন হোক, ইসরাইল ধ্বংস হোক, ইহুদিদের জন্য অভিশাপ ও ইসলামের বিজয় হোক। এই স্লোগানের ভেতরেই সংগঠনটির মনোভাব উপলব্ধি করা যায়। দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াইয়ে হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে আজ। আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিশিয়া থেকে ইয়েমেনে এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২০১৪ সালে হুথিরা ইয়েমেনের বেশিরভাগ এলাকা জয় করে নেয়। তারা দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুররাব্দু মনসুর হাদিকে ইয়েমেন ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ও পশ্চিমা সামরিক শক্তির সহযোগিতায় সুন্নি জোট সামরিক হামলা চালায় ইয়েমেন। ব্যাপক বিমান ও স্থল হামলা চালিয়েও সৌদি সামরিক জোট ইরান সমর্থিত হুথিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইয়েমেন ও সৌদি আরব যুদ্ধবিরতি করে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইল গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফিলিস্তিনের হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে লোহিত সাগরে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজে হামলা শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি হয়। ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে গাজায় যুদ্ধবিরোধী কার্যকর হলে হুথিরাও জাহাজ নিশানা করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করতে পারে ইসরাইল ও মার্কিন স্বার্থের জন্য হুথিদের সামরিক শক্তি মারাত্মক ভয়ের কারণ। তাদের আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাই এবার তারা কোনো ইস্যু ছাড়াই ইরানের অকৃত্রিম বন্ধু ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা হুথিদের নির্মূলে উঠে পড়ে লেগেছে।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপার পাওয়ারে অধিষ্ঠিত থাকার অন্যতম নিয়ামক শক্তি হলো মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য সম্পদের অবাধ লুটপাটের নিশ্চয়তা। সামরিক ঘাঁটি আর জনবিচ্ছিন্ন রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যা দীর্ঘদিন ধরে পেয়ে আসছে। কিন্তু ইরানের নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিনবিরোধী শক্তিগুলো আমেরিকার এই ফয়সালাকে প্রায়ই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। তাই এবার গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের মাধ্যমে মার্কিনবিরোধী হামাস, ইরানপন্থি হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে আমেরিকা আরব বিশ্বে তার লুটপাটের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যে কারণে বিনা উসকানিতে ইয়েমেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বর্বর হামলা। আর এই হামলার পরিণতি ইরানকেও যুদ্ধ ফ্রন্টে টেনে আনে কি না এখন এটাই দেখার বিষয়।
লেখন: সুমন আমীন, প্রাবন্ধিক